ঈদের উৎপত্তি যেভাবে : হাদিসের বর্ণনা ও সীরাত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাসূল (স.) মদিনায় হিজরত করার পর দেখতে পেলেন মদিনাবাসী বছরে দুটি উৎসব পালন করে। উৎসব দুটির একটির নাম নাইরোজ এবং অপরটির নাম মেহেরজান। উৎসব দুটিতে তারা খেলাধুলাসহ অন্যান্য আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত থাকত। এটাই ছিল তাদের ঐতিহ্য। নবী (স.) মুসলমানদের জন্য এই দুটির পরিবর্তে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামক দুুটি পবিত্র উৎসব প্রবর্তন করেন। নবী (স.) বললেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন প্রদান করেছেন। তার একটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন ও অপরটি হলো ঈদুল আযহারর দিন (আবু দাউদ শরীফ)।
ঈদুল আযহার মর্মকথা : আরবি শব্দ ‘আযহা’র বাংলা প্রতিশব্দ হলো কুরবানি। কুরবানি অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিজের সর্বাধিক প্রিয়বস্তু আল্লাহর রেজামন্দির জন্য উৎসর্গ করাই কুরবানির লক্ষ্য। কুরবানির ঈদ আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই শিশু ঈসমাইল (আঃ) ও আল্লাহর প্রেমে পাগল ইব্রাহিম খলিলুল্লার (আঃ) কুরবানির কথা। মাওলা প্রেমের এক বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন তিনি সমগ্র জগৎবাসীর কাছে। তবে কেবল পশু জবাই করা আর গোশত খাওয়া ও বিতরণের নাম কুরবানি নয়। বরং আল্লাহর রাহে নিজের জান-মাল ও কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ নিঃশঙ্কচে বিলিয়ে দেয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কুরবানি। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে মকবুল হবে না। দরকার হলো খালেছ নিয়ত। কারণ মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের কুরবানির গোশত ও রক্ত কোন কিছুই পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া বা আল্লাহভীতি (সূরা হজ: ৩)।
ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে তার শিশু পুত্র ঈসমাইল (আঃ) কে কুরবানি দেয়ার জন্য তৈরি হয়েছিলেন। এর মধ্যে অনেক সূক্ষ্ণ রহস্য নিহিত রয়েছে। তিনি শুধু সন্তানের গলায় ছুরি চালান নি, বরং প্রকৃতপক্ষে ছুরি চালিয়েছেন তার নিজস্ব প্রবৃত্তি ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আর এটাই হলো কুরবানির মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তি। প্রকৃতপক্ষে পশু কুরবানির সাথে সাথে নিজের সমস্ত পশুবৃত্তি ও কূ-প্রবৃত্তিকেও কুরবানি করা পবিত্র ঈদুল আযহার মর্মকথা।
ঈদুল আযহার রাতের ফজিলত : ঈদুল আযহার রাত বলতে ঈদের পূর্ব দিনের রাত বুঝায়। অর্থাৎ, ৯ ই জিলহজের রাত। আমরা অনেক সময় ঈদের আনন্দে সব কিছু ভুলে যাই, ইবাদতের কথা আর মনে থাকে না। অথচ ঈদের রাত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদিসে এসেছে, যদি কোন ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত জেগে ইবাদত করে তাহলে যে দিন অন্যান্য দিল মরে যাবে সেদিন তার দিল মরবে না অর্থাৎ কিয়ামতের দিনের আতংকে অন্যান্য লোকের অন্তর ঘাবড়ে গিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যাবে, কিন্তু দুই ঈদের রাত্রে জাগরণকারীর অন্তর তখন ঠিক থাকবে (তাবারানী, ইবনে মাজাহ)। সুতরাং ঈদের দিন রাতেও আমাদের বেশী বেশী ইবাদতে মশগুল থাকা উচিৎ।
ঈদুল আযহার দিনে করণীয় :
১. নিজ মহল্লার মসজিদে ফজরের নামায আদায় করা। ২. মিসওয়াক করা। ৩. গোসল করা। ৪. খুশবু ব্যবহার করা। ৫. সামর্থ্য থাকলে কুরবানি করা। ৬. সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরিধান করা। ৭. খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা। ৮. ঈদের ময়দানে যাওয়ার পূর্বে কোন কিছু না খাওয়া। ৯. কুরবানির গোশত দিয়ে দিনের খানা শুরু করা। ১০. সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণ দান-সদাকা করা। ১১. আগেভাগে ঈদগাহে যাওয়া। ১২. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। ১৩. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া এবং অপর পথে ফিরে আসা। ১৪. ঈদগাহে যাওয়ার সময় তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা। তাকবীরে তাশরীক হলো, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। ১৫. ঈদুল আযহার দিনে ফজরের ফরজ নামাজের পরে ঈদের জামাত পর্যন্ত আর কোন সুন্নত বা নফল নামাজ না পড়া । ১৬. ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়া সুন্নত। তবে যদি বৃষ্টি-বাদল হয় অথবা অন্য কোন বৈধ কারণ থাকে, তাহলে মসজিদে আদায় করা যায়।
কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামাবলী
কুরবানি যাদের উপর ওয়াজিব : প্রত্যেক সুস্থ জ্ঞানের অধিকারী, পূর্ণ বয়স্ক এবং মুকীম (মুসাফির নয়) ব্যাক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব যাদের কাছে ১০ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ মাল আছে। তবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাবের মত সম্পদের মালিকানা এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং কুরবানির তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানি ওয়াজিব হবে। যাকাতের নেছাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাবপত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয় না, কিন্তু কুরবানির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র, সৌখিন দ্রব্যাদি, খালি ঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর তার জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এমন কিছুর মূল্যও হিসেবে ধরা হয়।
কুরবানির পশুতে আকীকা করা : কুরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়ত করা যাবে। এতে কুরবানি ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।
নাবালেগ বাচ্চার কুরবানি : নাবালেগ শিশু-কিশোর এবং তদ্রুপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানি করলে তা সহীহ হবে।
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে : উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়। যেসব পশু কুরবানি করা জায়েজ সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানি করা যায়।
কুরবানির পশু কেমন হবে : কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানি জায়েয নয়। এমন দূর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়। যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারাও কুরবানি করা জায়েয নয়। যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানি জায়েয নয়। যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানি জায়েয নয় । যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট সে পশু কুরবানি করা জায়েয নয়।
কুরবানির পশুর বয়সসীমা : উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয়, তাহলে তা দ্বারাও কুরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়স হতে হবে। উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানি যাবে না।
পশুর বয়েসের ব্যাপারে বিক্রেতার কথা : যদি বিক্রেতা কুরবানির পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে আর পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কুরবানি করা যাবে।
শরীক নির্বাচনে সতর্কতা : শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানি সহীহ হবে না। যদি কেউ আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত করে কুরবানি করে তাহলে তার কুরবানি সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে।
পশু জবাইয়ের উত্তম তরীকা : কুরবানির ছুরি অত্যন্ত ধারালো হতে হবে যাতে পশুর বেশী কষ্ট না হয়। এক পশুর সামনে অন্য পশুকে জবাই করা যাবে না, এতে পশু ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পশু সম্পূর্ণ না মরলে চামড়া ছিলা যাবে না। পশুকে জবাইয়ের আগে অনেকক্ষণ ধরে মাটিতে রেখে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া : আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন, আল্লাহর নবী (স.) আমাকে তাঁর (কুরবানির উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দিব (বুখারী ও মুসলিম)। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।
জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে : অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানি সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না।
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানি কিভাবে হবে : বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানি করা জায়েয। কুরবানিদাতা এক স্থানে আর কুরবানির পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানিদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে।
কুরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ সাদকা করা : কুরবানির চামড়া কুরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি।
পরিশেষে সকল পাঠকের প্রতি অনুরোধ যে, কুরবানি ও কুরবানির ঈদের সূক্ষ্ণ মাসয়ালা ও নিয়ম-কানুন জানার জন্য অবশ্যই কোন বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হবেন। মহান আল্লাহপাক আমাদের কুরবানি ও কুরবানির ঈদকে কবুল করুন। আমীন।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/এমএইচবি