খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ মাঘ, ১৪৩১ | ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  নগরীর শেখপাড়া তেতুলতলায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অর্নব কুমার সরকার গুলিতে নিহত
একান্ত সাক্ষাতকারে ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার

‘ইসি অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে জনগণের আস্থাভাজন হতে চেয়েছে’

 নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচন কমিশন গত ৩ এপ্রিল কমিশনের ১৭তম সভায় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালট পেপারে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা খুলনা গেজেট-এর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কার্যভঙ্গিমা পর্যবেক্ষণকারী বিশিষ্ট নির্বাচন গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার এর কাছে জানতে চাই। ড. আখতার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে আমাদের প্রশ্নের যে উত্তর দেন তা পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করা হল :

খুলনা গেজেট : প্রফেসর আখতার আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে ইসি সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। সংস্থাটি ৩০০ আসনে কাগজের ব্যালটে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কেন ইসি এমন সিদ্ধান্ত নিল সে বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাই।

প্রফেসর আখতার : দেখুন এ নির্বাচন কমিশন একটি আমলানির্ভর কমিশন। জনাব সিইসিও ছিলেন সরকারের বিভিন্ন রকম সুবিধাভোগী। এরা স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবর্তে সরকারের অঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। কমিশন এর ঘোষিত নির্বাচনী রোডম্যাপ অনুযায়ী অনধিক ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে ইসি এককভাবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে এ জন্য দুই লাখ ইভিএম ক্রয় বাবদ ৮ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অর্থ মন্ত্রনালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় এ অর্থ বরাদ্দ করা তো দূরের কথা, প্রকল্পটি একনেক বৈঠকেই উপস্থাপন করেনি। বলা প্রয়োজন, পূর্ববর্তী ইসি কে এম নুরুল হুদা কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬টি সংসদীয় আসনে ইভিএম-এ নির্বাচন করলেও ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা ব্যয় করে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করেছিল। এর মধ্য থেকে ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম মেরামত করা বাবদ ইসি ১ হাজার ২ শত ৬০ কোটি টাকা চাইলে ওই টাকা দিতেও অর্থ মন্ত্রণালয় অপারগতা প্রকাশ করে।

খুলনা গেজেট : প্রফেসর আখতার, আপনি বললেন আগের ইসি দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিলেন। তাহলে তার মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম মেরামত করা লাগবে কেন? প্রায় ৭৪% ইভিএম কি নষ্ট হয়ে গেছে? ব্যাপারটি একটু স্পষ্ট করবেন কি?

প্রফেসর আখতার : দেখুন ইভিএম মূল্যবান যন্ত্র। এর রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম কানুন আছে। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্তগণ যথাযথভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ করেন নি বলেই হয়তো এত বেশি পরিমান ইভিএম অকার্যকর হয়ে গেছে। আমি মনে করি যারা ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা করেছেন তাদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। কারণ, এই কোটি কোটি টাকা যে নষ্ট হল এ টাকা তো জনগণের টাকা। আমাদের টাকা। অন্যদিকে, ইসিকে যে তার চাহিদা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ করতে পারল না, তার মধ্য দিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক দুরবস্থাই প্রতিফলিত হয়। ক্ষমতাসীন দল যেখানে ইভিএমে নির্বাচন চায়, সামর্থ থাকলে তো সরকারের ইসিকে ইভিএম ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া উচিত ছিল। সেজন্য ইসি ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করা থেকে সরে এসেছে।

খুলনা গেজেট : আপনি কি মনে করেন এ কারণেই ইসি ব্যালটে সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে?

প্রফেসর আখতার : দেখুন, আর্থিক কারণটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তবে এর সঙ্গে আরও অনেক কারণ জড়িত রয়েছে। এর মাধ্যমে ইসি’র অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে জনগণের আস্থাভাজন হতে চেয়েছে। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, ইসির আলোচ্য সিদ্ধান্তের দুয়েক দিন আগেই চিঠি দিয়ে ইসি বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানায়। যেহেতু বিএনপি ইভিএমবিরোধী এবং তারা এ ডাকে সাড়া দিলে ইসি তাদের দাবি অনুযায়ী ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালটে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দলটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে চেষ্টা করতো। কিন্তু বিএনপি ইসির এ ফাঁদে পা দেয়নি। দলটি এ ইসিকে স্বীকার না করে এর ১০ দফা আন্দোলন কর্মসূচির ৩ নম্বর দফায় এ ইসিকে ‘অবৈধ নির্বাচন কমিশন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বলেছে। ওই দফায় ইভিএম বাতিল করে ব্যালটে নির্বাচনের কথাও বলেছে দলটি। তবে আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত, ইসি’র স্টেকহোল্ডারদের সংলাপে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী ইভিএমে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ইসি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার পরোক্ষ কৌশলী প্রয়াস নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।

খুলনা গেজেট : তাহলে কি ধরে নেব আপনি বলতে চাইছেন যে, বিএনপি ইসির সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে সঠিক কাজ করেছে?

প্রফেসর আখতার : বিএনপির নীতি অনুযায়ী দলটি সঠিক কাজ করেছে। কারণ, দলটির এক নম্বর এজেন্ডা তো নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি। ওই দাবি অ্যাড্রেস না করে নির্বাচন ইভিএমে না ব্যালটে হলো সে দাবি পূরণ অর্থহীন কর্মকান্ড। আমার মনে হয় না যে বিএনপির প্রধান দাবি নিয়ে কোনো আলোচনা বা সংলাপে ডাকলে দলটি সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করবে।

খুলনা গেজেট : আপনি কি বলতে চাইছেন ব্যালটে নির্বাচন হলেই সে নির্বাচন স্বচ্ছ হবে না?

প্রফেসর আখতার : যথার্থই। নির্বাচন ব্যালটে নাকি মেশিনে হলো সে বিষয়টি স্বচ্ছ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয় না। নির্বাচন দলীয় নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলো সে বিষয়টি মূখ্য। কারণ, আপনারা দেখেছেন আগের দুটি সংসদ নির্বাচনে দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবারও দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন হলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে। দেশ পিছিয়ে পড়বে। কাজেই ভালো নির্বাচন চাইলে ইভিএম, ব্যালট বা অন্য বিষয় বাদ দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরুপ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হলে বিরাজিত পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সংঘাত এড়িয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হতে পারে।

খুলনা গেজেট : কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় নেতাগণ তো অব্যাহতভাবে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর ফিরে আসবে না। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এ বিষয়ে কি বলবেন?

প্রফেসর আখতার : একটু ধৈর্য ধরুন। কেবল নির্বাচন কমিশন চেষ্টা শুরু করেছে। এরপর সরকারও চতুর্মুখী চাপ শুরু হলে হয়তো নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের আলোচনার কথা ভাববে। সংবিধান তো মানুষের জন্য। নাগরিক প্রয়োজনে তো ১৭ বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। গণতন্ত্র, স্বচ্ছ নির্বাচন ও নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে প্রয়োজনে সরকার চাইলে আরেকবার সংবিধান সংশোধন করতে পারবে।

খুলনা গেজেট : আমাদের প্রশ্নগুলোর বিশ্লেষণ প্রদান করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

প্রফেসর আখতার : আমিও আপনাদেরকে আমার মতামত গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানাই।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!