ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ১১৩ জনে দাঁড়িয়েছে। হামাসের নজিরবিহীন হামলার জেরে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। হামলায় রোববার রাত ১টা পর্যন্ত অন্তত ৭০০ ইসরায়েলির মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সেনাসদস্য অর্ধশত। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্তত ১০০ ইসরায়েলিকে অপহরণ করেছে হামাস। সাত দশকের বেশি সময় আগে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশটি কখনও এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়নি।
হামাস ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালানোর ৪০ ঘণ্টার বেশি সময় পরও ইহুদিবাদী দেশটির ভেতরে বেশ কয়েকটি স্থানে লড়াই চলছে। হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজায় বিরামহীন আক্রমণ চালিয়ে বহু ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। এতে অন্তত ৪১৩ জন নিহত ও ২ হাজার ৩০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল এক পরিবারের ২২ জন মারা গেছেন। গাজায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ২০ শিশুও রয়েছে। ২০ লাখ বাসিন্দার এ উপত্যকার প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবার বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েল সরকার রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর আগে নেতানিয়াহু যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তবে সেই ঘোষণা ছিল প্রতীকী। ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইসরায়েলের সরকারি প্রেস অফিস জানিয়েছে, দেশটির মৌলিক আইনের ৪০ ধারা অনুযায়ী যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইসরায়েলের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। তবে এর ১৩টি মৌলিক আইন সংবিধান হিসেবে কাজ করে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত আটটি স্থানে হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই চলে। আলজাজিরা জানিয়েছে, নতুন করে শহর মাগেনে প্রবেশ করেছেন হামাসের আরও যোদ্ধা। তাদের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর তীব্র লড়াই চলছে। হামাস সদস্যদের প্রতিহত করতে সেখানে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে ইসরায়েলি বাহিনী।
হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসাম ব্রিগেডস বলেছে, তাদের যোদ্ধারা এখনও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি শহরে ‘ভয়াবহ সংঘর্ষে’ নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অফাকিম, সেদের, ইয়াদ মোর্দেচাই, কেফার আজ্জা, বেইরি ও কিসুফিম। হামাস নেতারা বলেছেন, ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে এ অভিযানের লক্ষ্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েক বছর ধরে এর প্রস্তুতি নেয় হামাস।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ভেস্তে যেতে পারে। শনিবার ভোরে গাজা থেকে জল, স্থল ও আকাশপথে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। অন্তত ১ হাজার হামাস যোদ্ধা ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিভাগ (আইডিএফ) দাবি করেছে, হামলা চালাতে যাওয়া হামাসের ৪০০ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে তারা। হামাসের হামলায় অন্তত ৪৪ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার ১৫৬ জন। সর্বশেষ এ সংঘাতের আগে ফিলিস্তিনিদের হামলায় ১৯৯৩ সাল থেকে নিহত ইসরায়েলির সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩০০।
ইসরায়েলে এ দফায় নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। হামাসের হাতে অপহৃতদের মধ্যেও মার্কিন নাগরিকরা রয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ এবং কঠিন যুদ্ধের সূত্রপাত হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘হামাসের ভয়াবহ আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছে এবং লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কোনো দ্বিধা ও অবকাশ ছাড়াই আক্রমণ চলবে। আমরা ইসরায়েলের নাগরিকদের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেব এবং আমরা জিতব।’ তিনি গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এ উপত্যকাকে ‘নির্জন দ্বীপে’ পরিণত করা হবে।
ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় দক্ষিণে রাফাহ থেকে উত্তরে বেইট হানুন (ইসরায়েলিদের কাছে এরেজ নামে পরিচিত) এলাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শহরে বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে বহু মানুষ। ইসরায়েল বলেছে, তাদের বাহিনী গাজা উপত্যকায় হামাসের গোয়েন্দাপ্রধানের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে হামলার সময় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তাদের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করবে এবং আমরা সে অনুযায়ী হামলার ফল প্রকাশ করব। তাঁর দাবি, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সক্ষমতার পুরোটা দিয়ে হামলা করছে এবং সামনেও তারা সেটাই করবে। গাজায় অনেক পরিবার ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। গাজার অন্তত ২০ হাজার বাসিন্দা জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেক ইসরায়েলিকে বন্দি করে রাখার কথা জানিয়েছে হামাস। হামাসের রাজনৈতিক শাখার উপপ্রধান সালেহ আল-আরোরি আলজাজিরাকে বলেন, এসব বন্দিবিনিময়ে হামাস ইসরায়েলের কারাগারে থাকা সব ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করতে পারবে। হামাস অনেক ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যা করেছে বলেও জানান তিনি। কতজনকে ধরে নিয়ে গেছে, সেই সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তাদের গাজার টানেলসহ বিভিন্ন স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। ইসরায়েল সরকার বলেছে, ১০০ জনকে অপহরণ করেছে হামাস। তাদের মধ্যে সেনাসদস্যও রয়েছে।
এদিকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ঘুরতে যাওয়া ইসরায়েলের পর্যটকের একটি বাসে গতকাল হামলা চালিয়েছে দেশটির একজন পুলিশ কর্মকর্তা। এতে দুই ইসরায়েলি এবং তাদের গাইড নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধের দামামার মধ্যে ইসরায়েল অধিকৃত লেবাননের শেবা খামারের তিন অবস্থানে আক্রমণ চালিয়েছে লেবাননের ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। এই হামলায় বিপুল পরিমাণ কামানের গোলা ও গাইডেড (সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম) ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানায় সংগঠনটি।
শনিবার হিজবুল্লাহ অপর এক বিবৃতিতে জানায়, তারা গাজার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ‘ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ’ রাখছে। হিজবুল্লাহ বলেছে, তাদের বন্দুক ও রকেট হামাস চাইলেই পাবে।
ইসরায়েলি প্রভাবশালী পত্রিকা হারেৎজ বলেছে, চলমান সংঘাতে হিজবুল্লাহর জড়িত হওয়াটা ইসরায়েলের জন্য আরও সংকট তৈরি করবে।
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েল ৩৪ দিনের যুদ্ধ করেছিল। এতে লেবাননের ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি নিহত হন, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে ১৬০ জন ইসরায়েলি মারা যায়, যাদের বেশির ভাগই সৈন্য ছিল। এ যুদ্ধকে ইসরায়েলের পরাজয় হিসেবে দেখা হয়।
ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তিনি হামাসের অভিযানের প্রশংসা করেছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ খবর দিয়েছে। দুটি সংগঠনকেই পৃষ্ঠপোষকতা দেয় ইরান সরকার।
হামাস বলছে, তাদের নেতা ইসমাইল হানিয়াহর সঙ্গে ফোনে ইসরায়েলের ওপর তাদের আকস্মিক হামলার প্রশংসা করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। পরে এক বিবৃতিতে রাইসি বলেন, তাঁর দেশ ফিলিস্তিনি জাতির বৈধ প্রতিরক্ষাকে সমর্থন করে। হামাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হানিয়াহ ইরানের অবস্থানের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
হামাসের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিছিল
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের সমর্থনে র্যালি করেছে মানুষ। এ সময় তারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় আগুন দিয়েছে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ফিলিস্তিনি পতাকা দুলিয়ে বিক্ষোভ করেছে তারা। ইসরায়েলের আঞ্চলিক শত্রু বলে পরিচিত ইরানের পার্লামেন্ট অধিবেশন শনিবার শুরু হয় সদস্যদের দুয়োধ্বনির মধ্য দিয়ে। তারা স্লোগান দিতে থাকেন– ইসরায়েল নিপাত যাক। ইসরায়েল ধ্বংস হবে। বিজয়ী হবে ফিলিস্তিন।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, শনিবার হামাসের অভিযানে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানের এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে।
রাজধানী তেহরানে ফিলিস্তিন স্কয়ারে সমবেত হন অনেক মানুষ। সেখানে আতশবাজিতে রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। রাজধানীর আজাদি স্কয়ারে একটি স্মৃতিস্তম্ভকে ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে আলোকিত করা হয়। তার ওপর লেখা ওঠে– ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিশোধ নিই।
লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে শত শত মানুষ হামাসের অভিযানকে সমর্থন করে রাস্তায় মিছিল করেছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ হামাসের পতাকা হাতে নিয়ে রাজধানী বৈরুতে মোটরসাইকেলে চক্কর দেন।
ইরাকের বসরা নগরীতেও হামাসের সমর্থনে র্যালি হয়েছে। সেখানে জনতা তাদের গাড়ি চালিয়ে এবং হামাস ও ফিলিস্তিনের পতাকা নেড়ে র্যালিতে অংশ নেন। তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত ফাতিহ মসজিদের সামনে সমবেত হন হাজারো জনতা। ইয়েমেনের তাইজ শহরেও র্যালি হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তিনি আশা করেন, হামাসের এবারের হামলা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি জাগরণী বার্তা। তাঁর দেশের জনগণ যতদিন প্রয়োজন, অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে। ফিলিস্তিনি জনগণ প্রয়োজনে আরও ১০০ বছর সংগ্রাম করবে। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোকে বুঝতে হবে ফিলিস্তিন ইস্যু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে শান্তি আসবে না। ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে হবে এবং সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা ও সিএনএন।
খুলনা গেজেট/এইচ