দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম কেন্দ্র যশোরের নওয়াপাড়ায় নব দিগন্তের সূচনা হতে চলেছে। জলাবদ্ধ বিলগুলোর ৫০৩ একর জমির ওপর ইপিজেড নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। এতে একদিকে যেমন নওয়াপাড়া নদী বন্দর, রেলওয়ে ও যশোর-খুলনা মহাসড়কের ত্রিমুখী অবস্থানকে আরও সমৃদ্ধ করবে। বিস্তৃত হবে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য। সেই সাথে দুঃখ ঘুচবে ভবদহ অঞ্চলের পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষের। অপরদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে দেড় লাখ মানুষের। আর সেখানে প্রাধান্য পাবে ভবদহের জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ।
ইপিজেড নির্মিত হলে সরাসরি ভাগ্য বদলাবে পাঁচ লাখ মানুষের। আর পরোক্ষভাবে নওয়াপাড়াসহ অভয়নগরের ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটার মাধ্যমে ১০ লক্ষাধিক লোক দেখবে নতুন স্বপ্ন। এক কথায় যশোর ইপিজেড নির্মাণের ফলে বদলে যাবে এ অঞ্চলের চিত্র। সেই সাথে মোংলা ও বেনাপোলের সাথে সরাসরি সংযোগ ঘটিয়ে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র বদলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ফলে সমৃদ্ধির এক নতুন পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে বলে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এ অঞ্চলের মানুষ।
জলাবদ্ধ এই বিলসহ আশপাশের অকৃষি জমি অধিগ্রহণ করে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ‘যশোর ইপিজেড’ নির্মাণের প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সেই সাথে এ অঞ্চলের জমি অধিগ্রহণ করতে জেলা প্রশাসককে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।
মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) যশোর ইপিজেডের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল কবির স্বাক্ষরিত চিঠি জেলা প্রশাসকের কাছে পৌঁছেছে। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, যশোর জেলায় শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের চেঙ্গুটিয়া এলাকায় চাষাবাদ অনুপযোগী জলাবদ্ধ খালে যশোর ইপিজেড স্থাপন করা হবে। এ জন্য অভয়নগরের মাগুরা, রাজাপুর, প্রেমবাগ, চেঙ্গুটিয়া, আরাজি বাহিরঘাট, বালিয়াডাঙ্গা, মহাকাল ও আমডাঙ্গা মৌজার ৫০৩ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।
এ বিষয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ভবদহ এলাকায় ইপিজেড স্থাপনের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন বিধি মোতাবেক ভূমি অধিগ্রহণসহ যাবতীয় কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি ও স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যশোর সদর, অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে ভবদহ এলাকা। ভবদহ বিল পাড়ের ১২০ গ্রামের অন্তত ৫ লাখ মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। ওই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানে এখন পানি আছে। কেশবপুর মনিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলার অন্তত ৪৫টি স্কুল-কলেজ পানিতে ভাসছে। এলাকার কবরস্থান ও শ্মশ্বানঘাটে পানি। যে কারণে ওই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও বনগ্রামের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, ভবদহের স্লুইসগেটে পলি জমে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যে কারণে ধলের বিলসহ দক্ষিণের প্রায় ২৭টি বিলের পানি জমে আছে। এসব বিলপাড়ের মানুষ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। কৃষিজমি পানির নিচে থাকায় হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। বিলে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করে, শাপলা ও কলমি শাক তুলের হাটেবাজারে বিক্রি করে কোনোরকমে মানুষ দিনযাপন করছেন। এই এলাকায় ইপিজেড স্থাপিত হলে লাখো মানুষ কাজ পাবে। ইপিজেডের কারখানা মালিকেরাও সস্তায় শ্রমিক পাবেন। এতে উভয় লাভবান হবে।
প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে যশোরের দুঃখ হয়ে আছে ভবদহ। বিলপাড়ের মানুষ বছরের পর বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন ইপিজেড স্থাপিত হলে এই এলাকার অর্থনীতির চাকা আবার সচল হবে।’
ইপিজেড স্থাপন প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ্ ফরিদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘এটা অত্যান্ত আনন্দের খবর এলাকাবাসির জন্য। কারন এ অঞ্চলের জমিজমা বছরের অধিক অংশ সময় পানির নিচে তলিয়ে থাকে। চাষাবাদ করতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করে। এতে করে এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে যেমন বেকার সমস্য লাঘব হবে তেমনি অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধি হবে এ অঞ্চলের মানুষ।’
ইপিজেড স্থাপনের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল কবীর বলেন, ‘যশোর ইপিজেড স্থাপনের জন্য ৫০৩ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য যশোর জেলা প্রশাসককে বলা হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে। যশোর ইপিজেড, চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাভারের ইপিজেডের মতোই হবে। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে ভবদহপারের অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের জীবনযাত্রার রূপ বদলে যাবে। তারা নতুন নগরায়ণের ছোঁয়া পাবেন। এই প্রকল্প ঘিরে ওই এলাকার নদী ও খাল-বিলেরও উন্নতি ঘটবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকেও আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। সব মিলিয়ে ভবদহপাড়ের মানুষের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।’
খুলনা গেজেট/ এস আই