দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পাশাপাশি ঘটনার পেছনে ‘নিছক চুরির উদ্দেশ্য বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে একটি মহল যে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে টিআইবি।
রোববার এক বিবৃতিতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান এবং এই হামলায় সরাসরি জড়িত ও আড়ালে থাকা অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে এ হামলার পর স্থানীয় প্রশাসনে যে নিরাপত্তাহীনতা ও আস্থাহীনতার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
গণমাধ্যমসহ নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘খাস জমি দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন ও ইটভাটাসহ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে দুর্নীতি ও অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে ঘোড়াঘাটের ইউএনও’র অনমনীয় অবস্থানের কারণে এ জাতীয় হামলা হয়ে থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, এরকম একটি উদ্বেগজনক ঘটনায় যেভাবে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তির প্রাথমিক স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করে একে ‘নিছক চুরি’ এবং একটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও সন্দেহজনক।
আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এভাবে বেশ কিছু দিন ধরে তদন্ত শেষ করার আগেই সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছেন। এটা কর্মদক্ষতার প্রমাণ নয়; বরং আইনি প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। এই প্রক্রিয়ার পেছন থেকে যারা কলকাঠি নাড়ে তারা আড়ালেই থেকে যায়। তদন্ত সংস্থার দায়িত্ব তদন্ত করা, মামলার দায় বা রায় ঘোষণা করা নয়। আমরা এই অপসংস্কৃতির অবসান চাই।
একজন সরকারি কর্মকর্তার ওপর হামলার পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী, দুর্নীতি সহায়ক ও স্বার্থান্বেষীদের কোনও ভূমিকা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক তদন্ত ও বিচারের দৃষ্টান্ত না থাকায় সংশ্লিষ্ট মহল ঘোড়াঘাটের ইউএনও’র ওপর হামলা করার সাহস পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে অনেক স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন যেমন আলোর মুখ দেখেনি, তেমনি জড়িত প্রকৃত অপরাধীরাও নানামুখী পরিচয়ের আড়ালে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার-ই উদাহরণ এই হামলার ঘটনা।
এটাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনও অবকাশ নেই; বরং যারা এভাবে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পাঁয়তারা করছে, তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে আরো সাবধান থেকে যথাযথ কারণ অনুসন্ধানপূর্বক ঘটনার মূলোৎপাটনে দৃশ্যমান ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তাগণ, বিশেষ করে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন যেকোনও প্রকারের ভয়ভীতি ও রাজনৈতিক চাপের ঊর্ধ্বে থেকে সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ ও ন্যায়-নিষ্ঠ আচরণ দেখতে চাই।
স্থানীয় পর্যায়ে কর্মরত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ যেমন আছে, একইভাবে সৎ, নির্ভীক ও ন্যায়-নিষ্ঠ থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্তও অনেক রয়েছে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘টিআইবির নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, গত কয়েক বছর ধরে নারী ইউএনওরা অনেক ঝুঁকি মোকাবিলা করে স্থানীয় প্রশাসনে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন। তাদেরই একজনের ওপর এই হামলা রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকটের বাস্তব ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভবপর না হলে দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সৎ, নির্ভীক ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের ওপর। এ ছাড়া প্রতিটি অপ্রীতিকর ঘটনাতেই কোনও না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার বিব্রতকর যে বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য আত্মবিশ্লেষণ করাটা এখন জরুরি বলে মনে করি।
খুলনা গেজেট/এনএম