চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামীর আমীর আহমদ শফীর ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জ এসেছে তারই অনুসারী জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষ থেকে।
মি: শফীর ছেলে আনাস মাদানী অভিযোগ করেছেন, গত দু’দিনে মি: বাবুনগরীর সমর্থক ছাত্ররা এবং কিছু বহিরাগত বিক্ষোভ করে মাদ্রাসাটির দখল নিয়েছিল। যদিও বাবুনগরীর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে।
তবে বিক্ষোভকারীরা মি: শফীকে মাদ্রাসার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে অব্যাহতি দেয়া সহ ছয় দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট বিলি করেছিল। বিক্ষোভ থেকে মি: শফী এবং তার সমর্থক শিক্ষকদের কক্ষে ভাঙচুর এবং একজনকে মারধোরের ঘটনাও ঘটে।
বিক্ষোভের মুখে মি: শফীকে হাজির করে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির বৈঠক করা হয় এবং সেই বৈঠকের পর আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার শিক্ষকের পদ থেকে অব্যাহতিও দেয়ার কথা জানানো হয়। শেষপর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দেয়। তারপরও ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে রাতে মাদ্রাসা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আল্লামা শফী। রাতেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ১২৪ বছরের পুরনো এই মাদ্রাসার নাম হচ্ছে, জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম। মি: শফী এই মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল এবং একইসাথে পরিচালকের দায়িত্ব পান ১৯৮৯ সালে। এর আগে ২০ বছরেরও বেশি সময় তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেছেন।
মাদ্রাসাটির একজন সাবেক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বেশ কয়েক বছর আগে তাকে অসম্মান করে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, মি: শফী যখন প্রধানের দায়িত্ব পালন শুরু করেন, তখন মাদ্রাসার বেশিরভাগ শিক্ষকই তার ছাত্র ছিলেন। ফলে তারা মি: শফীর কোন সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ড কখনও চ্যালেঞ্জ করতেন না। এছাড়া ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মি: শফীর ছেলে আনাস মাদানী মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান।
সাবেক ঐ শিক্ষক আরও জানিয়েছেন, একদিকে বেশিরভাগ শিক্ষকের পক্ষ থেকে কোন চ্যালেঞ্জ ছিল না, অন্যদিকে ৯০-এর দশকের শেষদিকে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসার প্রধান হিসাবে মি: শফীর একটা গুরুত্ব এবং ভাবমূর্তি তৈরি হয়। এ সবের সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতির কারণে মাদ্রাসাটিতে মি: শফী এবং তার ছেলে মি: মাদানীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব গড়ে ওঠে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এই শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, মাদ্রাসা পরিচালনার যে কমিটি রয়েছে, যাকে শূরা বলা হয়, ২০০০ সাল থেকে ১৬ বছর সেই কমিটির কোন বৈঠক করা হয়নি। একক নেতৃত্বে ছাত্র ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগ ও অপসারণসহ সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে কারণে কর্তৃত্ব বা মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল দীর্ঘ সময় ধরে। এখন তারই প্রকাশ ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
মি: মাদানী একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, মাদ্রাসার কোন কাজ একক সিদ্ধান্তে হয়নি এবং কোন ক্ষেত্রে অনিয়ম নেই। তিনি দাবি করেছেন, মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে স্বচ্ছতার সাথে সব কাজ হয়েছে। তিনি এখনকার ঘটনার পিছনে রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
মি: মাদানী রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, “যখন আলেম ওলামাদের সাথে সরকারের একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তখন তা নস্যাৎ করার জন্য দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী এটা করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য আন্দোলনের নামে মাদ্রাসায় ভাঙচুর এবং অনেক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।”
মাদ্রাসাটির একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেছেন, আহমদ শফীর বয়স একশ’র বেশি হয়েছে। বয়সের ভারে তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে কোন কর্মকাণ্ড চালাতে পারছেন না। ফলে তার উত্তরসূরি কে হবেন- এই প্রশ্নে অনেকদিন ধরেই মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে নানা আলোচনা ছিল।
তিনি জানিয়েছেন, মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক জুনায়েদ বাবুনগরীকে ২০১১ সালে সহকারী পরিচালক করা হয়েছিল। তিনিই উত্তরসূরি হতে পারেন-এমন একটা আলোচনা ছিল। কারণ তাকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিবও করা হয়েছিল। কিন্তু ঐ সিনিয়র শিক্ষক মনে করেন, আনাস মাদানীর পরামর্শে মি: শফী মাদ্রাসার সাবেক একজন শিক্ষক শেখ আহমদকে আবার ফিরিয়ে আনেন। তখন এটা স্পষ্ট হয় যে মি: বাবুনগরীকে ঠেকানোর জন্য তাকে আনা হয়েছে। এনিয়ে মি: বাবুনগরী এবং তার সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল।
গত এপ্রিল মাসে মি: বাবুনগরীকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে শেখ আহমদকে সেই পদে বসানো হয়। সে সময়ও মাদ্রাসায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তা তখন প্রকাশ হয়নি। পরে রমযানের মধ্যেও একই ইস্যুতে উত্তেজনা দেখা দিলে তখন দুই পক্ষ আলোচনার পর মি: মাদানী এবং মি: বাবুনগরী ছাত্রদের সামনে একসাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
যদিও মি: বাবুনগরীর সমর্থক হিসাবে পরিচিত মাদ্রাসাটির একজন শিক্ষক আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেছেন, ছাত্রদের বিক্ষোভের সাথে মি: বাবুনগরী বা তাদের কোন সম্পর্ক নেই। ভর্তিসহ নানা ক্ষেত্রে হয়রানির জন্য মি: মাদানীর প্রতি ক্ষোভ থেকে ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
মাদ্রাসাটির পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ডের কারণে রাজনীতিও একটা বিষয় হয়েছে দ্বন্দ্বের পিছনে। তিনি আরও বলেছেন, ২০০৯ সালে হেফাজতে ইসলাম যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পর্যায়ে। ২০১৩ সালে বিভিন্ন দাবি নিয়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হলো।
এরপর হেফাজতে ইসলাম এবং আহমদ শফী এবং আনাস মাদানীর সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়। সেই প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড নিয়েও মি: শফীর সাথে জুনায়েদ বাবুনগরী এবং তার সমর্থকদের দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকে। পরিচালনা কমিটির ঐ সদস্য মনে করেন, মি: বাবুনগরী সরকার বিরোধী অবস্থানের হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
মি: শফীর সমর্থকদের পক্ষ থেকে মি: বাবুনগরীর বিরুদ্ধে বিএনপি জামায়াতের সম্পৃক্ত রাখার অভিযোগ করা হয়। যদিও তিনি তা বিভিন্ন সময় অস্বীকার করেছেন। তবে মাদ্রাসার একজন সাবেক শিক্ষক মনে করেন, মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সাথে বাইরের রাজনীতি এবং ব্যক্তিস্বার্থের কারণেও সেখানে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে এবং এখন পরিস্থিতি অস্থির হয়েছে।
দেশে সবচেয়ে বড় এই কওমি মাদ্রাসায় সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। অন্য কওমি মাদ্রাসাগুলোর বেশিরভাগই হাটহাজারীর এই মাদ্রাসার নির্দেশনা অনুসরণ করে থাকে।