মূল্যস্ফীতির চাপ ও বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটানোর বাড়তি ব্যয় মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর মধ্যে পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে মেটানো হবে। বাকি ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণে দেশীয় ও বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান গ্রহণ করা হবে।
গতকাল বুধবার অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হার-সংক্রান্ত কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের এসব প্রাক্কলন অনুমোদন করা হয়। একই সঙ্গে বৈঠকে চলতি বাজেটের বাস্তবায়ন ও অর্থনীতির সার্বিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হয়।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে সরকার মোট ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে। এটি আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। পরবর্তী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়। সে হিসাবে চলতি বছরের তুলনায় আগামী বাজেটের আকার বাড়ছে ৮১ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে এনবিআর, এনবিআরবহির্ভূত এবং করবহির্ভূত রাজস্ব থেকে মোট ৫ লাখ কোটি টাকা আয় করতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া এনবিআরবহির্ভূত করের মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা আশা করছে সরকার। চলতি বাজেটে এ দুই খাতে যথাক্রমে ১৮ হাজার কোটি ও ৪৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়।
শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। শর্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে এনবিআরের কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়াতে হবে। এক হিসাবে দেখা গেছে, এ সংস্থাটিকে আগামী অর্থবছর স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে অতিরিক্ত ৪৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে।
এ জন্য এনবিআরকে বেশি পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এনবিআরের এরই মধ্যে গৃহীত বেশ সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
মোট ব্যয়ের বাকি ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা স্থানীয় এবং বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ অনুদানের মাধ্যমে মেটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৯৪ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুদান এবং বাজেট সহায়তা মোট ১১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাকি ৩০ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করবে সরকার।
ভর্তুকি ও নগদ প্রণোদনায় বরাদ্দ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি : অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে সার্বিকভাবে ভর্তুকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক দফায় ৫ শতাংশ করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বর্তমানে কিছু কম হওয়ায় আগামীতে এসব খাতে ভর্তুকি কিছুটা কমবে।
তবে মূল্যস্ফীতির প্রভাবে চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি বেড়েছে। তাই চলতি বাজেটে ভর্তুকি খাতে যে অর্থ বরাদ্দ রয়েছে, তা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এমনকি আগামী অর্থবছরে চলতি অর্থবছরের ৯ থেকে ১০ মাসে বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়া লাগতে পারে। এ ছাড়া আগামীতে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে কৃষি ও খাদ্য খাতে ভর্তুকি বাড়াবে সরকার। এসব কারণে আগামী বাজেটে চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে ভর্তুকি ও নগদ প্রণোদনা খাতে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৯৯ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে শুধু কৃষি খাতে বাড়ানো হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা : এদিকে, গত কয়েক বছর থেকে সরকারের পরিচালন বাজেটে ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধ। সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, লাইবর রেট অত্যধিক বেড়ে যাওয়া, ইউএস ট্রেজারির সুদহার বাড়ার পাশাপাশি দেশের বাজারে ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বাড়ায় আগামী অর্থবছরে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা হবে। এটা আগামী বাজেটের জিডিপির ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে জিডিপির ১ দশমিক ৮০ শতাংশ ধরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা : সুদ ও ভর্তুকিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ বেশি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বাজেটের তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ মাত্র ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে আগামী বাজেটে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এডিপিতে সরকারের অর্থ বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা রয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামী বাজেটে এডিপি বাস্তবায়নে ৯৪ হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বাজেটে যা রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ : দেশে গত মার্চ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থবছর শেষে তা বেড়ে প্রায় ৯ শতাংশ হতে পারে বলে বিভিন্ন সংস্থা ধারণা করছে। সরকার মনে করছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসার প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে। তাই আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।