টানা ১১ দিনের রক্ত ঝরানো যুদ্ধের পর আপাতত শান্তির সুবাতাস বইছে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিমতীরে। শুক্রবার ভোর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে নিষ্কৃতি পান ফিলিস্তিনিরা।
মিসরের মধ্যস্থতায় এ অস্ত্রবিরতিকে হামাস নিজেদের ‘জয়’ বলে ঘোষণা করেছে। আর অস্ত্রবিরতির খবর প্রকাশ্যে আসতেই গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নেমে ‘বিজয় মিছিল’ করেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
গাজায় গত ১১ দিন ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি হামলার মুখে উৎকণ্ঠায় পার করেছেন প্রতিটি মুহূর্ত। যুদ্ধবিরতির খবরে তারা গাজার রাস্তায় নেমে আসেন। মসজিদগুলোর মাইকে মাইকে ঘোষণা করা হয়, ‘ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিজয় অর্জিত হয়েছে।’
আরবিতে তারা সৃষ্টিকর্তার শোকর করে বলছিলেন— ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহতায়ালাকে ধন্যবাদ।’
রমজান মাস শেষে বিশ্বজুড়ে ঈদ উদযাপিত হলেও গত সপ্তাহে সেই উৎসব ঠিকঠাক করতে না পারা গাজার অনেক বাসিন্দাকেই দেখা গেল স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে রাস্তায় নেমে এসে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে ১১ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষে আসা যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় উল্লাস প্রকাশ করতে।
গভীর রাতে শহরটির বিভিন্ন অংশে আরবিতে স্লোগান উঠল— ‘আল্লাহ মহান, তাকে ধন্যবাদ।’
প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে গাড়ির ভিড়, হর্নে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা, জানালা দিয়ে উল্লসিত মানুষের পতাকা উড়ানো- আগের সব যুদ্ধবিরতি বা বন্দি বিনিময়ের সময়ের মতো এবারও গাজাকে এমন উৎসবমুখরই দেখা গেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
অনেকে জয়সূচক ’ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন। অনেক শিশুও নেমে এসেছে সড়কে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর শহরটির বিভিন্ন মসজিদের লাউডস্পিকারে হামাস যোদ্ধাদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। ঘোষিত হয় ‘সোর্ড অব জেরুজালেম যুদ্ধে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিজয়’।
উল্লসিত অনেককে দেখা যায় শূন্যে গুলি ছুড়তে। কেউ কেউ ব্যস্ত শব্দ বোমা ফাটাতে কিংবা আতশবাজি পোড়াতে।
’দখলদারদের বিরুদ্ধে এ এক অসাধারণ জয়। আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করেছে। আজ থেকেই ঈদ শুরু হচ্ছে। অনেকে ঘরবাড়ি ও আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমরা উৎসব করব,’ বলেছেন বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে শামিল হওয়া ৩০ বছর বয়সি আহমেদ আমের।
তবে এ উল্লাসের মধ্যে আছে সতর্কতাও। যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে যুদ্ধবিরতি। দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা তো যে কোনো মুহূর্তেই নতুন সংঘাত-সংঘর্ষে মোড় নিতে পারে।
একে-৪৭ বন্দুক হাতে থাকা একজন যেমন বললেন, “আমাদের আঙুল এখনও ট্রিগারে, আমরা ফের যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তবে এখন আমরা আমাদের জনগণের সঙ্গে আনন্দ উদযাপন করব।”
কেবল গাজা-ই নয়, উল্লাস দেখা গেছে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থাকা শহর রামাল্লাতেও। শুক্রবার রাতে শহরটির সড়কে নেমে আসা কয়েকশ মানুষ স্লোগানে বলেছেন, “মনেপ্রাণে আমরা তোমার সঙ্গেই আছি, গাজা।”
আতশবাজির ঝলক দেখা গেছে পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারা এলাকায়ও। এখানে বসবাসরত কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারের উচ্ছেদ ঠেকাতে ইসরাইলের আদালতে যে দীর্ঘ আইনি লড়াই চলছে, তা নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকে রমজান মাসে জেরুজালেমজুড়ে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল।
অস্ত্রবিরতির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ফিলিস্তিন সরকার। গত ১১ দিনের হামলা চলাকালে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ভূমিকা অনেকটাই গুরুত্বহীন ছিল। হামাস ফাতাহ দ্বন্দ্বে পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ক্ষমতাসীন ফাতাহ দলের নিযুক্ত ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ বলেন, ‘মিসরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শক্তির যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সাফল্যকে আমরা স্বাগত জানাই।’
গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, এবারের ১১ দিনের সংঘর্ষ ২৩২ ফিলিস্তিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে; এদের মধ্যে আছে ৬৫টি শিশুও। ইসরাইলি কামানের গোলা ও বিমান হামলায় আহতও হয়েছে দুই হাজারের কাছাকাছি।
গাজার নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৬০ জনই হামাসের যোদ্ধা ছিল বলে দাবি ইসরাইলের। তাদেরও প্রাণহানি হয়েছে। হামাসের রকেটে ১২ ইসরাইলি নিহত ও কয়েকশ আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে তেলআবিব।
ইসরাইলের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়াকে নিজেদের ‘বিজয়’ হিসেবে দেখছে হামাস।
দলটির এক নেতাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানিয়েছে, এটা ফিলিস্তিনি জনগণের ‘বিজয়’ এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘পরাজয়’।
হামাস নেতারা এও বলেছেন, ঘোষণা এলেও যুদ্ধবিরতি চুক্তির খুটিনাটি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা সতর্ক অবস্থায় থাকবেন।
খুলনা গেজেট/কেএম