খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

আম্ফান-ইয়াসের সময় একজন পিসি রায়ের প্রয়োজন ছিল

কাজী মোতাহার রহমান

১৯১৯ ও ১৯২০ সাল, তখন ব্রিটিশ জামানা। লর্ড চেমস ফোর্ড বাংলার ভাইসরয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিনিধি। তিনি ভারতবর্ষের শাসনকর্তা। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম গণ আন্দোলন হিসেবে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২২)।

বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে ভারতে যে শাসন আইন প্রণীত হয় তা দেশবাসীর আশা আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়। এ আইন দ্বৈত শাসন নামক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে ব্রিটিশ সরকার দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থাকে প্রহসনে রূপান্তর করে। ফলে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ জনতার আন্দোলনের গতিধারা স্তব্ধ করার জন্য সরকার রাওলাট আইন প্রর্বতন করে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করে। এর বিরুদ্ধে ‘সত্যাগ্রহ’ নামে কংগ্রেস নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী যে অহিংস আন্দোলনের ডাক দেন তা ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯২১ সালে ৫ নভেম্বর গান্ধীজীর ‘আইন আমান্য’ আন্দোলনে ভারতের ৩০ কোটি হিন্দু মুসলমান সাড়া দেয়। উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা থানা আক্রমণ করে জনতা ২৩ জন পুলিশকে হত্যা করে। চৌরিচৌরা ঘটনার জের ধরে আন্দোলনের ইতি ঘটে (মোঃ ওয়াহেদুল ইসলাম রচিত ইতিহাস প্রথম পত্র)।

রাজনীতিতে এমন এক সংকটময় মুহুর্তে ১৯১৯-২০ সালে অনাবৃষ্টিতে ফসলহানির ফলে খুলনার শ্যামনগর, আশাশুনি, তালা, পাইকগাছা ও দাকোপে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ধান ও সুপেয় পানির সংকটে এলাকাবাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে। মানুষ ঢ্যাপ (শাপলার ফল), শালুক ও কচুরপাতা সেদ্ধ করে জীবন ধারণ করে। দুর্ভিক্ষ অস্বীকার করে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। ঠিক সেই মুহুর্তে মানব প্রেমিক বিজ্ঞানী পিসি রায় দুর্গতদের সেবায় খুলনা রিলিফ কমিটি গঠন করেন। সে সময়কার প্রখ্যাত আইনজীবী জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোয়, নগেন্দ্র নাথ সেন ও কুঞ্জুলাল ঘোষ এ কমিটির অর্ন্তভুক্ত হন। তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। মানষকে ত্রাণ দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত ৬০ হাজার টাকা দিয়ে পূর্ণবাসন প্রকল্প গ্রহণ করেন।

১৯২২ সালের ২২-২৭ সেপ্টেম্বর প্রবল বর্ষায় আত্রাই নদী প্লাবিত হয়ে রাজশাহী, নওগাঁ ও বগুড়ায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানী পিসি রায় বন্যা সাহায্য সমিতি গঠন করেন। সে সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন (রনজিৎ কুমার মন্ডল রচিত আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়)। বন্যা সাহায্য সমিতির দায়িত্ব বিজ্ঞানী পিসি রায় নিজে কাঁধে তুলে নিলেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বোম্বাই কটন মিলের মালিকরা ও বিভিন্ন দেশের শিল্পপতিরা পিসি রায়ের নামে ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে শুরু করেন। শিল্পপতিরা জানতেন দেশপ্রেমিক পিসি রায়ের হাতে সাহায্য পাঠালে তা অপচয় হবে না। দিনরাত পরিশ্রম করে এ সব ত্রাণ সামগ্রী বন্যার্তদের কাছে পৌঁছাতেন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা ও কলকতা থেকে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী আসতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে ‘ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান’ এর সংবাদদাতা উল্লেখ করেন দুর্গতরা সঠিক সেবা পাবে, সুষ্ঠু বিতরণ হবে পিসি রায়ের এই ব্রতের কারণে বিদেশীরা ত্রাণ সামগী পাঠাচ্ছে। আরও একটি বড় বিষয় তিনি জাতীয়তাবাদী ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সমালোচক। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহাত্মা গান্ধী যদি আরও দু’জন পিসি রায় গড়ে তুলতে পারতেন তাহলে একবছরের মধ্যে ভারত স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হতো।

২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান এবং ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস নামক দুর্যোগে দক্ষিণ জনপদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। গর্ভবতী নারী-শিশু সীমাহীন দুর্ভোগ পোহায় আশ্রয় শিবিরে। মানুষের আয়ের কোন উৎস ছিল না। রাস্তাঘাটের অস্তিত্ব ক্ষেত্র বিশেষ বিলীন হয়। হাটু পানি অতিক্রম করে মাসের পর মাস এলাকাবাসীকে অতিবাহিত করতে হয়। বয়োবৃদ্ধরা অনাহারে দিন কাটায়। এ সময় ত্রাণ সামগ্রী ছিল অপ্রতুল। বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকে কয়রায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে গেলে সেখানকার পুলিশ বাঁধা দেয়। এমনকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সমর্থকদের নন্দিত নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সাথেও পুলিশ অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই শ^াশত সত্য।

জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও খুলনা ৬ আসনের সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবু ক্ষতিগ্রস্থদের শান্তনা দেওয়ার জন্য কয়রার দশালিয়ায় উপস্থিত হলেও তার দলীয় কর্মীরা তাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদা ছুঁড়ে স্বস্তা বাহবা নেয়। এটি হীনমানসিকতার ফসল। কোন যুগের রাজনৈতিক কালচারে আসেনা।

আম্ফান ও ইয়াসের মতে দুর্যোগকালীন সময় দক্ষিণ জনপদে বরেণ্য বিজ্ঞানী পিসি রায়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ সময় একজন পিসি রায়ের প্রয়োজন ছিল, যার আহবানে বিদেশীরা ত্রাণ সামগ্রী পাঠাবে নিশ্চিন্তে। পিসি রায়কে অনুসরণ করে রিলিফ কমিটি গঠনের কোন নেতৃত্ব ছিলনা। তার আজকের এ জন্মদিনে মানবতার কল্যাণের জন্য কর্মজীবনের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!