খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

আম্পানের এক বছর : এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি উপকূলের লক্ষাধিক মানুষ

রুহুল কুদ্দুস, সাতক্ষীরা

প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতের দীর্ঘ এক বছর পার হলেও এখনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। প্লাবিত এলাকায় লবণাক্ততার তীব্রতায় কৃষিকাজ না হওয়ায় অভাবগ্রস্থ উপকূলের অধিকাংশ মানুষ। বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনের আতঙ্কে এখনও তটস্থ সবাই। যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে বিচ্ছিন্ন। চিকিৎসা, সুপেয় পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সংকটে এখনও বিপর্যস্থ উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সাতক্ষীরার গোটা উপকূলীয় এলাকা। প্রবল ঝড়ে উপকূলের নদ-নদীর অন্তত ২০টি পয়েন্টে ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫৭ কিলোমিটার ভেড়িবাঁধ ও এলজিইডি এবং সড়ক বিভাগের ক্ষতি হয় কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার সড়ক। পানিবন্দী হয়ে পড়ে উপকূলীয় এলাকার ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। কাজ না থাকায় সেখানকার লোকজন বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছেন। আম্পানের এক বছর পার হলেও উপকূলীয় এলাকায় গৃহহীনের সংখ্যা এখনও দুই শতাধিক। বেড়িবাঁধের রাস্তার ওপর খুপড়ী ঘরে বসবাস তাদের।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যমতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সাতক্ষীরায় দুইজন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়। ঝড়ে ২২ হাজার ৫১৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৬০ হাজার ৯১৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ে সাতক্ষীরায় ৬৫ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা ৪০ হাজার টাকার আমসহ ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার কৃষি সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ে ৯১টি খামার ও ৬৪০টি গবাদি পশুসহ ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৩০ টাকার গবাদি পশু এবং ৮৬টি হাস মুরগির খামারসহ ৭৭ লাখ টাকা ৬৭ হাজার ৮৬ টাকার হাঁস-মুরগির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে সাড়ে ১২ হাজার মৎস্য (চিংড়িসহ) ঘের। যার ক্ষতির পরিমাণ ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা টাকা। ঝড়ে হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়ে।

আশাশুনির প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, ঘূণিঝড় আম্পানের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সাতক্ষীরার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল আমার ইউনিয়ন। আমার ইউনিয়নে ৪০ কিলোমিটার বাঁধের সব নষ্ট হয়ে গেছে। আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর চাকলা, দিঘলারআইট, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, কুড়িকাহুনিয়া, হিজলিয়া কোলাসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। পাউবোর বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন পয়েন্ট গুলো মেরামতের পর ইউনিয়ের আভ্যন্তরীণ সড়ক গুলো মেরামত করে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, প্রতাপনগর ইউনিয়ন কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটায় নদী দ্বারা বেষ্টিত। চারিদিক দিয়ে রয়েছে পাউবো’র বেড়িবাঁধ। এসব বেড়িবাঁধের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাও খুবই নাজুক। আগামী বর্ষা মৌসুমের মধ্যে এসব বাঁধ সংষ্কার করা না গেলে আবারও প্লাবনের কবলে পড়তে হবে তাদের। নদীতে জোয়র বৃদ্ধি পেলেই ভাঙ্গন আতংকে ভোগে ইউনয়নের ভূক্তভোগিরা। জনগণের জানমাল রক্ষার তাগিদে তিনি তার ইউনিয়নে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণসহ দ্রুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান।
শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর ৬টি পয়েন্টে ২কিলোমিটার বাঁধ ভেঙ্গে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়।

গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, আম্পানের পর লেবুবুনিয়া, নাপিতখালি ও জেলেখালি এলাকায়র বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। এই ইউনিয়নের মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০ কিলোমিটার ভেঙ্গে যায়।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম আতাউর রহমান জানান, আম্পানে আমার ইউনিয়নের বন্যতলা, কামালকাটি, ঝাপা, ছোট চন্ডীপুর, পূর্ব পাতাখালি, পশ্চিম পাতাখালি, খুঁটিকাটা ও চাউলখোলা পয়েন্টগুলোর বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়। মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২৪ কিলোমিটার ভেঙ্গে যায়।

শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল জানান, কোলা, ঘোলা ও হাজরাখালী পয়েন্ট বাঁধ ভেঙ্গে তার ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক ও জনপদ বিভাগের কয়েক কিলোমিটার সড়ক। এখনো পর্যন্ত এই সড়কের সংষ্কার কাজ করা সম্ভব হয়নি। গৃহহারা অনেকেই এখনো পাউবো’র বেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছে।

সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য আব্দুল হাকিম মোড়ল বলেন, প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি। আম্পানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নে। আজও সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এলাকায় রয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। একই সাথে ওই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে একরকম বিচ্ছিন্ন। ইউনিয়নের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে বেগ পোহাতে হয় মানুষকে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিকাংশ বেঁড়িবাধ গুলো রয়েছে ভয়াবহ অবস্থায়। যে কোন সময় নদ-নদীর প্রবল জোয়ারের চাপে তা আবারও ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। তিনি উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল জানান, ঘূণিঝড় আম্পানে জেলার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি ও আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল এ অঞ্চলের বেড়িবাঁধগুলোর। প্রধানমন্ত্রী পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে অতিসত্ত¡র ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, পানিউন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনীসহ জেলার সংশ্লিষ্ট সংস্থা অক্লান্ত পরিশ্রম করায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ গুলো প্রাথমিকভাবে সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে। আম্পানে ক্ষতগ্রস্থদের পুনর্বাসনের কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। তিনি এসময় সাতক্ষীরা জেলাকে দুর্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ঘোষণার দাবী জানান।

খুলনা গেজেট/কেএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!