আমার সাংবাদিকতার গুরু শাহাবুদ্দিন আহমেদের আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২১ সালের ২ জুলাই দিনগত রাতে প্রবীণ সাংবাদিক শাহাবুদ্দীন আহমেদ ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯৮২ সালে পহেলা সেপ্টেম্বর দৈনিক জন্মভূমির মাধ্যমে আমার সাংবাদিকতা শুরু। স্পষ্টবাদী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকারী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রটি আমার মনে নেই। কেন জানি শাহাবুদ্দিন ভাই আমাকে প্রথম দর্শনে খুব আপন করে নেন। এরপরে সংবাদ সংগ্রহে আমি সব সময় শাহাবুদ্দিন ভাই সঙ্গী হতাম। তবে আমি সব সময় চাইতাম খুলনা শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমি শাহাবুদ্দিন ভাইকে আগে জানিয়ে চমক সৃষ্টি করবো। তবে কখনোই আমার এই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ তার নেটওয়ার্ক এত স্ট্রং ছিল কোন ঘটনা ঘটলেই তিনি সাথে সাথেই খবর পেয়ে যেতেন। তখন কিন্তু আজকাল কার মতন মোবাইল ফোন ছিলনা। কিন্তু তার কাছে খবর ঠিকই পৌঁছায় যেত। শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। প্রথমত তিনি সবসময় বলতেন নিজে ঘটনাস্থলে যাবা, নিজের চোখে দেখবা, তারপরে রিপোর্ট করবা। আর কখনোই অতিরঞ্জিত কোন শব্দ সংবাদে ব্যবহার করবা না। যেটুকু ঘটনা তাই লিখবা। আর একটা বিষয় সবসময় গুরুত্ব দিতেন তোমার নেটওয়ার্ক বাড়াও। তোমার সোর্সের কাছে তুমি বিশ্বস্ত হও। তাহলে দেখবা তোমার কাছে খবর হেঁটে হেঁটে আসবে।
খুলনার সুশীল সমাজে তিনি সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এমনকি তার অফিসেও তার পাঠানো নিউজ কখনোই কলম চালাতো না সাব এডিটররা। মজার বিষয় হলো তিনি যে সংবাদ ফ্যাক্সের মাধ্যমে পাঠাতেন তাতে শেষে তিনি নিজের নাম ও খুলনা লিখতেন। তার অনেক প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে তার নাম ও খুলনা শব্দ দুটি ও ছাপা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সাথে আমরা অনেক হাসাহাসি করতাম। ব্যক্তি শাহাবুদ্দিন ভাইকে আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি। তিনি নীরবে অনেক অসহায় পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতেন। আর এই টাকা প্রদানের সময় আমি অনেক ক্ষেত্রে তার সঙ্গী হতাম। তার নিষেধ ছিলো কাউকে একথা বলা যাবে না। এমন কি অনেক পেশাদার সাংবাদিকের পাশে তিনি দাড়িয়েছেন। তেমনি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, শাহ মোয়াজ্জেম অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ তার সরাসরি বন্ধু ছিলেন। তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে অনেক উপহার পাঠিয়েছেন। কিন্তু শাহাবুদ্দিন ভাই কখনোই ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। এখন যেটা অনেকটা বিরল।
একদিনের ঘটনা বলি দৈনিক ইত্তেফাক অফিস তখন সিমেট্রি রোডে। আমরা সবাই ইত্তেফাকের বুড়ো প্রধান আইয়ুব ভাইয়ের অফিস নিয়মিত আসতাম। ওখানে শাহাবুদ্দিন ভাই, সাদেক ভাই সহ আমরা অনেক জুনিয়ারই জড় হতাম। একদিন আমি একটি ঘটনার ব্যাপারে অজ্ঞতার কারনে আংশিক ভুল তথ্য শাহাবুদ্দিন ভাইকে প্রদান করি। তিনি রেগে আমাকে একটা চড় মারেন। কেন আমি ভুল তথ্য সংগ্রহ করলাম এটাই আমার অপরাধ। চড়ে ব্যথা না পেলেও তার সন্তানতুল্য স্নেহের কারণে আমার চোখ বেয়ে পানি এসেছিল। তিনি এতই রাগ হয়েছিলেন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললেন এখন থেকে আরো সতর্কভাবে তথ্য নেবে। আসলে গুরুর মার না খেলে ভাল কিছু হওয়া যায় না।
একদিন সন্ধ্যায় পিকচার প্যালেস মোড় থেকে আমি আর শাহাবুদ্দিন ভাই হাত ধরাধরি করে খুলনা থানার দিকে যাচ্ছি। বিষয়টি তখন নজরে আসে তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাক্তার আলিমুজ্জামান। সিভিল সার্জন আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি যেদিন বদলি সূত্রে খুলনা ত্যাগ করার আগেরদিন তার অফিসে বসা। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন তোমাকে কেন এত স্নেহ করি তুমি জানো। আমি বললাম আমি করে বলবো? তিনি আমাকে না চিনলেও শাহাবুদ্দিন ভাইকে আগের থেকেই চিনতেন। আমাদের দুজনের হাত ধরা করে রাস্তায় হাটার দৃশ্যটি দেখে তিনি বুঝেছেন শাহাবুদ্দিন সাহেব যখন এই ছেলেটির হাত ধরে হাঁটছে তখন সে নিশ্চয়ই ভালো। সেই দিন থেকে আমি একটি শিক্ষা পেয়েছি ভালো মানুষের সাথে রাস্তায় চললে তার পরিচিত লোকজন সঙ্গী কেউ ভালো মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আপনি যতই ভালো মানুষ হন খারাপ লোকের সঙ্গে চললে ওই মানুষটির পরিচিতজন আপনাকে খারাপ মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করবে। আমার অনেক সহকর্মীকে আমি এই গল্পটি বলি। পেশাগত প্রয়োজনে অনেক খারাপ লোকের সাথে আমাদের কথা বলতে হয় তবে সেটা প্রকাশ্যে না বলাই ভালো।
আমার গুরুর মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া করি মহান আল্লাহতালা তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমিন।
লেখক : খুলনা বিভাগীয় প্রধান, এনটিএন বাংলা, খুলনা ও আহবায়ক, পেশাজীবী সাংবাদিক সুরক্ষা মঞ্চ, খুলনা