খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

আমার আইজিপি পদক ও এসপি সাহেবের পিপিএম পদক প্রাপ্তি

এ এম কামরুল ইসলাম

আমি তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার। বরিশাল থেকে বদলি হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগ দেওয়ায় আমাকে কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার করা হলো। কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি স ম আছাব হোসেন ছিলেন জাঁদরেল অফিসার। লেখাপড়া, সাজগোজ, চালচলন এবং পেশাগত দায়িত্বে তাঁর জুড়ি পাওয়া দায়। তিনি আমাকে তাঁর থানায় পোস্টিং করিয়ে নিয়ে গেলেন। ঢাকা শহরে পুলিশের চাকরির ‘ডান-বাম’ কিছুই আমি তখন বুঝতাম না। আমার থাকার জায়গা হলো থানার পাশে হোটেল ‘ময়ুর’এ একটি ছোট রুমে। অবশ্য হোটেলে বেশিদিন থাকা খাওয়া অস্বাস্থ্যকর বিধায় আমার মেঝো ভায়রাভাই জনাব মিজানুর রহমান সাহেব একদিন জোর করে আমাকে তাঁর বাহাদুরপুর লেনের ভাড়া বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীসহ বেশে কিছুদিন ছিলাম।

একদিন খুব ভোরে আমার হোটেলের রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেখতে পেলাম বরিশাল জেলায় কর্মরত আমার একজন অতি প্রিয় অফিসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বরিশাল সদর সার্কেলের দায়িত্বে থাকা এএসপি বাদশা মিয়া। সেখানে চাকরি করাকালীন তিনি আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। বরিশালের এসপি সাহেব তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমে পায়ে হেঁটে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে আমার হোটেলের ঠিকানা সংগ্রহ করেছিলেন।

আমি তাঁকে কোনমতে ছোট্ট রুমের একপাশে থাকা চেয়ারে বসতে দিলাম। তিনি আমার হাতে ছোট্ট একটা মেডেল তুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য সুখবর। এটা আইজিপি মেডেল। এবারের পুলিশ সপ্তাহের পরে তুমি পেয়েছো। এসপি সাহেব নিজের হাতে এটা রিসিভ করে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমি এটা থানায় রেখে যেতে পারতাম; কিন্তু এসপি সাহেবের কড়া নির্দেশ আছে, তোমার হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়ার।’

আমি বললাম, আইজিপি পদক কি স্যার? এটা কেন আমাকে দিয়েছে?

‘কেন, মনে নেই? তুমি আর এসপি সাহেব শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর লুট হওয়া রাইফেল উদ্ধার করেছিলে ও পরে সেই গোসাইরহাট থানার লুন্ঠিত এলএমজি উদ্ধার। এসব ভাল কাজের জন্য এসপি সাহেব পিপিএম পদক পেয়েছিলেন। তোমার জন্য আইজিপি পদক প্রদানের সুপারিশ করে এসপি সাহেব চিঠি লিখেছিলেন। দেরিতে হলেও তুমি সেই পদক পেয়েছো। তাই এসপি সাহেব খুশি হয়ে তোমার হাতে-হাতে পদক পৌঁছে দিতে আমাকে পাঠিয়েছেন।’

আমি অবাক হয়ে আবার বললাম, আইজিপি পদক কি স্যার?

‘বুঝবে, বুঝবে। এর মূল্য অনেক। আরো কিছুদিন গেলে আস্তে-আস্তে বুঝবে। প্রোমোশনের সময় অনেক কাজে লাগবে। তুমি সময় করে এসপি সাহেবের কাছে ফোন করবে।’

‘জি স্যার। অনেক ধন্যবাদ। আপনি একটু বসেন। আমি নাস্তার অর্ডার দিচ্ছি।’

এক প্রকার জোর করে তাঁকে নাস্তা খাওয়ানোর পর তিনি বিদায় নিলেন। আমিও গোসল-নাস্তা সেরে মেডেল হাতে নিয়ে থানায় গিয়ে প্রথমে ওসি সাহেব, এসি সাহেব ও অন্যান্যদের দেখালাম। সকলে আমাকে বাহবা দিতে লাগলেন। আমিও বেশ আনন্দ উপভোগ করলাম।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, বর্তমানে আইজিপি পদক দেওয়া হয় পুলিশ সপ্তাহ চলাকালীন সরাসরি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের মাঠে। আমি যখন আইজিপি পদক পেয়েছিলাম তখন পুলিশ সপ্তাহ শেষ হওয়ার পর আইজিপি পদকের জন্য প্রস্তাবিত পুলিশ সদস্যদের নাম যাচাই-বাছাই করে উপযুক্ত মনে করলে তাদের পদক সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়া হতো। আমি যখন আইজিপি পদক পেয়েছিলাম তখন আমি বরিশাল জেলায় না থাকায় পদকের প্রস্তাব প্রেরণ ও পদক প্রাপ্তি সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না। তাছাড়া তখনও চাকরিতে নতুন হওয়ায় ও এসব নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ না থাকায় আমি কোন খোঁজখবর রাখতাম না। তখনকার দিনে বিপিএম, পিপিএম ও আইজিপি পদক পাওয়া অত্যন্ত দু:সাধ্য ব্যাপার ছিল। সারা বছরে সমস্ত পুলিশের মধ্য থেকে ১০/১৫ জনকে বাছাই করে বিপিএম, পিপিএম ও কয়েকজনকে আইজিপি পদক প্রদান করা হতো।

আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে চাকরি করেও বরিশাল জেলা থেকে আইজিপি পদক পাওয়ার নেপথ্যের কিছু কথা বলা দরকার।

আগেই বলেছি এর অন্যতম কারণ ছিল শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর লুন্ঠিত রাইফেল উদ্ধার। সেই সাথে আরো একটি কারণও ছিল। এখানে সেই ঘটনা খুলে বলার চেষ্টা করছি।

একদিন সন্ধ্যার একটু আগে হঠাৎ থানায় খবর এলো যে, বরিশাল শহরের অদূরে সাগরদী এলাকায় কয়েকজন সন্ত্রাসী একটি বাড়িতে সারাদিন ঘুমিয়ে ছিল। সারারাত এলাকায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ভোর হয়ে পড়ায় তারা লোকজনের ভয়ে তাদের একজন আশ্রয়দাতার বাড়িতে আত্মগোপন করার জন্য ঘুমিয়ে ছিল। বিকালের দিকে এলাকার লোকজন ঘটনা জানতে পেরে ঐ বাড়ি ঘেরাও করে রাখে; কিন্তু সাহস করে কেউ তাদের ধরতে যায়নি বা বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করেনি। তখন বরিশাল এলাকায় সর্বহারা ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির দৌরাত্ম ছিল বেশ। এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে জীবন যাপন করতো। সেই সুযোগে ঐ বাড়িতে রাতে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা একে একে বোরখা পরে পালিয়ে যায়।

একপর্যায়ে দুই একজন সাহসী মানুষ ঐ ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ঘরের মেঝেতে বস্তায় ভর্তি কিছু জিনিস দেখে সন্দেহ পোষণ করে। তৎক্ষণে সন্ত্রাসীরা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকার কেউ-কেউ ঘরে ঢুকে বস্তার ভিতরে ভারী কিছু আছে বলে সন্দেহ করে আমাদের খবর দিয়েছিল। আমরাও কালবিলম্ব না করে তাদের সহায়তা করতে ছুটে যাই। ঘরে ঢুকে বস্তা খুলে দেখা গেল একটি এলএমজি পার্ট-পার্ট করে খোলা। সারদার ট্রেনিংএ এলএমজি খোলাজোড়া বেশ ভালভাবেই শিখেছিলাম। সারদার ট্রেনিংএ রপ্ত করা দক্ষতায় সাথে-সাথে খোলা অস্ত্র জোড়া লাগিয়ে দেখা গেল পুরা আস্ত এবং সক্রিয় একটা এলএমজি। ঘটনাস্থলে বসেই বাট ও বডি নম্বর নিয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে জানানো হলো। তারা ওয়্যারলেসে গোসাইরহাট থানায় যোগাযোগ করলো। সেখান থেকে পাওয়া বাট ও বডি নম্বর আমাদের উদ্ধারকৃত এলএমজির সাথে হুবহু মিলে গেল। খবর পেয়ে এসপি সাহেব নিজেই ঘটনাস্থলে হাজির হলেন। পুলিশের পুরনো অফিসারের মধ্যে কেউ-কেউ তাঁকে পরামর্শ দিলেন গোলাগুলির ঘটনা সাজাতে। কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন মোটামুটি সহজ সরল। তবুও শেষ পর্যন্ত বিশেষ সাড়াশি অভিযান দেখিয়ে এলএমজি উদ্ধার দেখানো হলো। সারাদেশে হৈ-চৈ পড়ে গেল। চারদিকে এসপি সাহেবের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। বরিশাল জেলা পুলিশের ভাবমূর্তি বেড়ে গেল।

এর আগে শিকারপুর ফেরিঘাটে আনসার বাহিনীর লুন্ঠিত রাইফেল উদ্ধার ও চলতি অভিযানে গোসাইরহাট থানার লুন্ঠিত এলএমজি উদ্ধারের ঘটনা এসপি সাহেবের নেতৃত্বে হয়েছে দেখিয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে পিপিএম পদকের প্রস্তাব পাঠানো হলে ঐ বছরের পুলিশ সপ্তাহের সময় সরকার তাঁকে পিপিএম পদক প্রদান করে। এসপি সাহেবের এই পদক প্রাপ্তির সময় আমি বরিশাল জেলায় ছিলাম। তিনি যেদিন ঢাকা থেকে পদক নিয়ে বরিশাল ফিরছিলেন সেদিন আমরা পুলিশ লাইনের ব্যান্ড পার্টি নিয়ে বরিশাল জেলার প্রবেশ পথে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। বরিশাল জেলার সীমানা থেকে তাঁকে রিসিভ করে গাড়িবহর নিয়ে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণপূর্বক অফিসে আনা হয়েছিল। পরদিন সকালে বরিশাল পুলিশ লাইনে বিশাল ধুমধাম, খাওয়া-দাওয়া ও রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।

আমার প্রাপ্ত আইজিপি পদক এই ঘটনারই কিয়দংশ ছিল। অবশ্য আমি পদক প্রাপ্তির আগেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে বদলি হওয়ায় এবং এসব নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ না থাকায় সবকিছুই আমার অজানা ছিল। তাই আকস্মিকভাবে এএসপি সার্কেল জনাব বাদশা মিয়া আমার হোটেলে আইজিপি পদক নিয়ে হাজির হওয়া আমার জন্য কতটা আনন্দের বিষয় ছিল তা এখন কাউকেই বুঝিয়ে বলতে পারবো না।

আনন্দ

আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আইজিপি পদক পাওয়ার খবর শুনে মনে-মনে গর্বিত হয়েছিলাম।

আমার চাকরি জীবনের প্রথম কর্মস্থল বরিশাল জেলা হওয়ায় ঐ জেলার প্রতি আমি দুর্বল ছিলাম। আমার দুর্বলতার পুরস্কার প্রাপ্ত হয়ে আরো বেশি ঋণী হয়ে গেলাম। চাকরি জীবনে ‘Parents district’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সে অনুযায়ী বরিশাল আমার ‘Parents district’ ছিল।

আমার প্রমোশনের সময় আইজিপি পদক কাজে আসবে শুনে মনটা বেশ আনন্দিত ছিল।

বেদনা

সকল প্রাপ্তিই প্রাপকের কাছে অতি আনন্দের বিষয় হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্যের কাছে প্রায়ই ঈর্ষার কারণ হতে দেখা যায়। এটা বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব। কিন্তু বরিশালে না থাকায় এবার আমাকে সেটা দেখতে হয়নি। তাই এই ঘটনায় বেদনার কিছুই উল্লেখ করা হলো না। চলবে …

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্তপুলিশ সুপার, অব.)

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!