ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সাড়ে ৯ মাসের মাথায় মুখ খুললেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গত পরশু ভারতের ‘দ্য ওয়াল’কে একটি অডিও সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাতের পর কানাডা থেকে প্রকাশিত ইউটিউব চ্যানেল ‘দ্য নাগরিক টিভি’র সঙ্গেও কথা বলেন কাদের।
দুটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় পালিয়ে ভারতে অবস্থানকারী কাদেরের মধ্যে জুলাই গণহত্যার ঘটনায় কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। উল্টো তিনি সাক্ষাৎকার নেওয়া সাংবাদিকের সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলন। একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত কাদের এক পর্যায়ে ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, ‘আপনার এই চেহারাটা, বক্তব্যটা কোথায় যাবে? যদি আমরা ফিরে যাই। তখন তো আপনাকে খুঁজেও পাওয়া যাবে না।’
দুটি গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে জুলাই হত্যার বিষয়ে এখন ক্ষমা চাওয়া বা ভুল স্বীকার করতে রাজি হননি শেখ হাসিনার মন্ত্রী সভার এই সদস্য। তিনি বলেন, যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে ভুল স্বীকার করব। তবে সেটা দেশে গিয়ে, বিদেশে বসে নয়।
গণমাধ্যম দুটির সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও কাদের প্রথমবারের মতো ‘সাধারণ সম্পাদক’ হিসেবে বিবৃতি দিয়েছেন। গত ২৬ মে রাত ১টা ১০ মিনিটে তার বিবৃতি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়। বিবৃতিতে ব্যক্তিগত বা দলের পক্ষে কোনো ধরনের ভুল স্বীকার করেননি তিনি। উপরন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। হুমকি দেন সরকার পতনের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু ওবায়দুল কাদের নয়, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেউই সেই অর্থে নিজেদের ভুল স্বীকার বা জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার দিকে যায়নি। তবে, গত ২১ নভেম্বর ভারতে অবস্থানরত দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে টেলিফোনে বলেন, প্রকৃতপক্ষেই আমরা যদি ভুল করে থাকি অথবা অন্যায় করি তার জন্য জাতির কাছে ক্ষমতা চাইতে আপত্তি অথবা আমরা ক্ষমা চাইব না- এ ধরনের গোঁড়ামি আমাদের ভেতরে কাজ করে না। এই মানসিকতার দল আওয়ামী লীগ নয়। তবে, অনুশোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা গত সাড়ে ৯ মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অসংখ্যবার কথা বলেছেন। তবে, তাকে কখনোই ক্ষমা চাওয়া বা ভুল স্বীকার করতে দেখা যায়নি।
গত পরশু ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়ালের এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুলাই আন্দোলনকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে আখ্যায়িত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বিষয়টি দেশ-বিদেশ এবং ভারতবর্ষের সবার কাছে পরিষ্কার। ৫ আগস্ট সেদিন ষড়যন্ত্রমূলক যে ছাত্র উত্থান….। তিনি বলেন ৫ আগস্ট রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ছিল না। এটা ছিল লুটপাটের অভ্যুত্থান।
ঘটনার দিন নিজের বাসা থেকে পালিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি অন্য একজনের বাসার বাথরুমে লুকিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করে সাক্ষাৎকারে বলেন, ছাত্ররা তাকে খুঁজে বের করেছিল। এবং তারাই তাদের মাস্ক পরিয়ে অসুস্থ চাচা-চাচি পরিচয় দিয়ে বাঁচিয়ে ছিল। ওই ছাত্ররা কেউ আওয়ামী লীগের নয় বলে জানান কাদের। আওয়ামী লীগ হলে তিনি চিনতেন বলে দাবিও করেন।
৫ আগস্টের পর তিন মাস আত্মগোপনে থেকে তিনি ‘কিছু একটা’ করতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে শ্রমিক-কর্মচারীর অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
কানাডাভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ‘নাগরিক টিভি’র এডিটর ইন চিফ নাজমুস সাকিবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কাদের স্বীকার করেন ছাত্ররাই তাকে বাঁচিয়েছেন। বাংলাদেশে তিন মাস অবস্থানকালে যেটা দেখেছেন আওয়ামী লীগকে নিয়ে মানুষের ক্ষোভ। এই ক্ষোভটা আপনি কি মনে করেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরে পদ্মা সেতু আমরা করেছি। মেট্রোরেলও আমরাই করেছি। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েও তো আমাদের করা।’
রাতের ভোট, ডামি নির্বাচনকে ভুল সিদ্ধান্ত মনে করেন কি না জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো আলোচনার অপেক্ষা রাখে! সেগুলো চর্চা করার বিষয় আছে। আমাদেরও একটা দৃষ্টিকোণ আছে। একটা ইলেকশন লিগ্যালি করতে হয়। সেটি আমরা করেছি।…. আজকে অপিনিয়ন পোল নেন, বেশির ভাগ লোক চায় শেখ হাসিনা আবার আসুক এবং শেখ হাসিনাকে আবার চাই। এ কথা আজ মানুষের মুখে মুখে। ইলেকশনটা হলে বুঝবেন।
শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কি তার রাজনীতির জন্য একটা লজ্জাজনক অধ্যায় না? এমন জবাবে কাদের বলেন, ‘নো, আমি এটা মনে করি না। তখন তার বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল। কারণ তাদের সেদিন প্ল্যানই ছিল তাকে হত্যা করবে।’
বেগম খালেদা জিয়াও তো মারাত্মক শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। তিনি তো কম্প্রোমাইজ করেননি। কিন্তু আপনাদের নেত্রী তো কম্প্রোমাইজ করে ভারতে চলে গেলেন! জবাবে ওবায়েদুল কাদের বলেন, না, কম্প্রোমাইজ করে যাননি। তাকে (শেখ হাসিনা) বাঁচার দরকার ছিল। সে জন্য চলে আসছেন। কাদের দাবি করেন, এখন বাংলাদেশে আপনারা অপিনিয়ন পোল নেন, মানুষ কাকে সমর্থন করে দেখেন। আমি সে কথায় যাচ্ছি বারবার।
আওয়ামী লীগ করেন, এজন্য আপনি বিশ্বাস করেন জনপ্রিয়তা বাড়ছে- সাংবাদিকের এমন বক্তব্যের জবাবে কাদের বলেন, ‘আমি সে কথা ভাবব কেন। দেশের পাবলিক অপিনিয়ন কি এটা আপনি জানেন না?,
এ সময় সাক্ষাৎকার নেওয়া সাংবাদিকদের ‘বায়াসড’ আখ্যায়িত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনি একটা দলের সমর্থক হলে তো জানবেন না। এটাই স্বাভাবিক। আপনি তো! হোয়েন ইউ আর এ বায়াসড অ্যাজ এ জার্নালিস্ট। আপনি ঢালাও অভিযোগ করছেন।
আপনাদের এখনো কি কোনো অনুশোচনা বা আত্মোপলব্ধি হয়েছে, মানে আপনারা যা করেছিলেন সেগুলো কী সঠিক ছিল, এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের আত্মোপলব্ধি, আমাদের আত্মসমালোচনা থাকতে পারে এবং সেটা নিয়ে আমরা চর্চা করব। যখন আমরা দেশে ফিরব। সেখানে আলোচনা করে যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে ভুল স্বীকার করব। সেটা দেশে, বিদেশে বসে নয়।
সাংবাদিক নাজমুস সাকিব বলেন, ‘শেষ প্রশ্ন আপনাকে করতে চাই। তাহলে আপনারা কি কখনোই জনগণের কাছে আপনাদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চাইবেন না?’ উত্তরে কাদের বলেন, আমি সে কথার জবাব দিয়েছি। শুনতে পাননি? আমরা যাই করব দেশে গিয়ে করব।
এ সময় নাজমুস সাকিব বলেন, ঠিক আছে আমরাও আপনাদের দেশে আসার অপেক্ষায় থাকলাম। আপনি ভালো থাকবেন। কাদের জবাবে বলেন, তখন আর আপনাদের দেখা যাবে না।
এদিকে গত ২৬ মে ওবায়দুল কাদের একটি বিবৃতি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়। ওই বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ করার ঘোষণাকে ‘নাটক’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, জনগণের চোখে ধুলা দিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট ইউনূস অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। বিদেশি প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। দেশ বিক্রির সব পরিকল্পনা জনগণের সামনে ফাঁস হয়ে গেছে। এখন সময় পতনের এবং আওয়ামী লীগ দেশপ্রেমিক জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অবৈধ দখলদার ফ্যাসিস্ট ইউনূস গংয়ের পতন ঘটাবে।
আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করার কারণে তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা মাহমুদা। আমার দেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, তারা অপরাধ করেছেন জেনেশুনেই। ইচ্ছে করেই এই কাজগুলো তারা করেছে। কাজেই তাদের কোনো অনুশোচনা তো আসবে না।
আয়েশা মাহমুদা বলেন, যারা এই অপরাধটা করেছেন তারা নিজেরা এটাকে কোনো অপরাধই মনে করেননি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, আমরা যাই করি না কেন এ জাতিকে তা মুখ বুঝে সহ্য করতেই হবে।
এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, আমার প্রায়ই মনে হয় তারা কী সত্যি বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন? যারা বাংলাদেশি হবে না তারা তো বাংলাদেশিদের ওপর অত্যাচার করবেই। কারণ কোনো নাগরিক তার নিজ দেশের মানুষের ওপর এভাবে নির্মম অত্যাচার করতে পারেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, তারা গত সাড়ে ১৫ বছরে মানুষকে খুন করেছে, গুম করেছে। অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। বিশেষ করে ছাত্রদের ওপর পাখির মতো গুলি করেছে। কিন্তু তাদের অনুশোচনা করতে দেখছি না। এদের সামান্যতম দুঃখবোধ নেই। তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে এরা মানুষ নয়, মানুষরূপী দানব। মানুষ হলে তাদের মধ্যে অনুশোচনা দেখা যেত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তার দলের এমপি-মন্ত্রীরা আত্মগোপনে চলে যায়। পরে এদের কেউ কেউ সীমানা পার হয়ে ভারতে পাড়ি জমায়। কেউ কেউ বিমানবন্দর হয়েও বিদেশে পালিয়ে যায়। বেশকিছু নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সরকার পতনের পর প্রভাবশালী নেতা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই সময় কোন কোন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয় ওবায়দুল কাদের বিশেষ একটি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলাতে অবস্থান করছেন। আবার অন্য গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয় তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্যও। অবশ্য এর আগে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্যটিতে গুঞ্জন আকারে প্রকাশিত হলেও নভেম্বরের প্রথমদিনে তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরটি বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়। সরকারের একটি অংশ তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে বলেও গুঞ্জন ওঠে। উল্লেখ্য, ‘দ্য ওয়াল’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের তিন মাস পর ভারত যাওয়ার যে তথ্যটি জানিয়েছেন। সেটি নভেম্বরের প্রথম দিকে পালিয়ে যাওয়ার তথ্যের সঙ্গে মোটামুটি মিলে যায়।
খুলনা গেজেট/এমএনএস