খুলনা, বাংলাদেশ | ১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আগামীর বাংলাদেশ হবে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতার : ড. ইউনূস
  জুলাই-আগস্টে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে সময় লাগবে : উপদেষ্টা আসিফ

ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩ অভিযোগ, ঢাকায় ৪ মামলা

গেজেট ডেস্ক 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, দলের নেতা ও রাজনৈতিক মিত্রদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় তিনটি আবেদন জমা পড়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি ও হত্যার নির্দেশদাতা এবং পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়েছে। ব্যক্তির পাশাপাশি দল-সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অজ্ঞাত নেতাকর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্যরাও রয়েছেন আসামির তালিকায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় বুধবার (২১ আগস্ট) পৃথক তিনটি মামলার আবেদন করা হয়।

আবেদনকারীরা হলেন- কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলনে নিহত চট্টগ্রামের ওমরগণি এম ই এস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্তর বাবা মো. জাকির হোসেন, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী শেখ শাহরিয়ার বিন মতিনের বাবা মো. আব্দুল মতিন ও মিরপুরের সেনপাড়া এলাকার মো. আসিফ ইকবালের বাবা এম এ রাজ্জাক।

জাকির হোসেনের আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ ৭৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। আব্দুল মতিনের আবেদনে শেখ হাসিনাসহ ৫০ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অজ্ঞাত অস্ত্রধারী এবং অজ্ঞাত পুলিশ সদস্যদের আসামি করা হয়েছে এ আবেদনে।

রাজ্জাকের আবেদনে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৭১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

১৬ জুলাই বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর এলাকায় অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারান শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত। শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন ঢকার মিরপুরে খালার বাসায় বেড়াতে এসে ১৮ জুলাই খালাত ভাইয়ের সঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেয়। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয় তিনি।

পরে ২০ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শাহরিয়ার বিন মতিন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। ১৯ জুলাই মিপুরের গোল চত্বর এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন মো. আসিফ ইকবাল। সেখান থেকে উদ্ধার করে আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

১৪ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। এসব ঘটনার তদন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এই ঘোষণার আগে-পরে এখন পর্যন্ত সাতটি মামলার আবেদন তদন্ত সংস্থা কমপ্লেইন্ট রেজিস্ট্রারভুক্ত করা হয়েছে বলে জানান উপপরিচালক (প্রশাসন) ও তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সাতটি অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি আবেদন ২০১৩ সালের ঘটনায়। বাকি ৬টি আবেদন কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় করা হয়েছে। এই ছয়টি অভিযোগের তদন্ত একসঙ্গেই হবে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক তদন্তকাজ শুরু হয়েছে।

মামলার তিনটি আবেদনের ভাষা প্রায় একই। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আসামিদের পরিকল্পনা ও নির্দেশে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করা। এর মধ্য দিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন আসামিরা।

আবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীদের পাশাপাশি পুলিশ-র‌্যাবের সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। কমপক্ষে ৪৩৯ জন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১০ হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। এক হাজার লোককে চিরতরে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। তাছাড়া কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আবেদনে আরো বলা হয়েছে, আসামিদের নির্দেশ ও পরিকল্পনায় সারা দেশে ২৮৬টি মিথ্যা মামলায় সাড়ে ৪ লাখ আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে ১২ হাজার আন্দোরনকারীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ এর ৩(২), ৪(১)(২) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। অতএব, অভিযোগটি নিবন্ধনভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দল-সংগঠন সত্ত্বার বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

হত্যার অভিযোগে ৪ মামলা

গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মামলার আবেদনের পাশাপাশি কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলনে চারজনকে হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো চারটি হত্যা মামলা আবেদন করা হয়।

বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এসব আবেদন মিরপুর, রামপুরা, সূত্রাপুর ও তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নিয়মিত এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। এসব মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াকিল উদ্দিন, মাঈনুল হোসেন খান নিখিল, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশসহ ১১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মিরপুর থানার মামলায় বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহায়ক ফিরোজ তালুকদার মিরপুর-১০-এর গোলচত্বর হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় র‌্যাব হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই গুলিতে ফিরোজ নিহত হন। বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসানের আদালতে মামলাটি করেন নিহতের স্ত্রী রেশমা সুলতানা। আদালত বাদীর জবানবন্দি নিয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচ জনকে আসামি করেছেন। অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

রামপুরা থানার মামলায় বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর রামপুরা এলকায় রাসেল মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বুধবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমীর আদালতে মামরার আবেদন করেন নিহতের স্ত্রী শারমিন আক্তার। আদালত বাদীর জবানবন্দি নিয়ে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) অভিযোগটি নিয়মিত এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

শেখ হাসিনার সঙ্গে এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াকিল উদ্দিন, মাঈনুল হোসেন খান নিখিল, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিআইজি রিপন সরদার, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদ, সাবেক সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান ও সাবেক র‌্যাব ডিজি হারুন-অর-রশীদ।

সূত্রাপুর থানার মামলায় বলা হয়েছে, ১৯ জুলাই লক্ষ্মীবাজার এলাকায় জুমার নামাজের পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনতা মিছিল শুরু করে। তখন ৫০-৬০ জন অস্ত্রধারী এবং পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। গুলিতে কবি নজরুল কলেজের সামনে নিহত হন এলেম আল ফায়দি। এ ঘটনায় বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে মামলার আবেদন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামসুল আরেফিন। আদালত বাদীর জবানবন্দি নিয়ে অভিযোগটি সূত্রাপুর থানাকে নিয়মিত এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে এ মামলায় আরো ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

তেজগাঁও থানার মামলায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগেরদিন ৪ আগস্ট রাজধানীর ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজের নিচে গুলিতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিইচ্ছু শিক্ষার্থী মো. তৌহিদুল হক। বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হুদা চৌধুরীর আদালতে ৪৯ জনের জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন নিহতের বড় ভাই তারিকুল ইসলাম। আদালত বাদীর জবানবন্দি নিয়ে তেজগাঁও থানাকে অভিযোগটি নিয়মিত এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনাসহ এ মামলার আসামি ৪৯ জন।

অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন- ওবায়দুল কাদের, আছাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, হারুন-অর-রশীদ, বিপ্লব কুমার, হাবিবুর রহমান, সাদেক খান, শাহজাহান খান।

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!