আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি, ব্যবহার হচ্ছে নানা রকম সব প্রযুক্তি। এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য । এই আধুনিক যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে গ্রামের সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। যা আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না।
একসময় গ্রামগঞ্জে ধান ভানা, চাল তৈরি, গুঁড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙানোসহ বিভিন্ন কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো ঢেঁকি।ঢেঁকির ধুপুর-ধাপুর শব্দে মুখরিত ছিল গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ আর শোনা যায় না। কাঠের ঢেঁকি এখন গ্রামীণ জনপদের বিলুপ্ত প্রায়।
অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কৃষক ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষানিদের ঘরে ধান থেকে নতুন চাল ও চালের গুঁড়া করার ধুম পড়ে যেত। সে চাল দিয়ে পিঠা-পুলি, ফিরনি-পায়েস তৈরি করা হতো।
জানা যায়, সত্তর দশকে প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়োর পিঠার গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঢেঁকি তৈরি করা হতো বরই, বাবলা ও জামগাছের কাঠ দিয়ে। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য, আর পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু। মাথায় বসানো হতো এক হাত পরিমাণের কাঠের দস্তা। দস্তার মাথায় লাগানো থাকে লোহার গুলা। এর মুখ যে নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে সে স্থানকে গড় বলে। এই গড়ে ভেজানো চালে পাড় দিয়ে তৈরি করা হয় চালের গুঁড়া।ঢেঁকিতে ধান বা চাল মাড়াই করতে কমপক্ষে তিনজন মানুষের প্রয়োজন হয়। পেছনের লেজবিশিষ্ট পুরু অংশে এক বা দুজন পা দিয়ে তালে তালে চাপ দিলে দস্তা সজোরে গরের ভেতর ধান বা চালের ওপর আঘাত করে। তবে দস্তার ওঠানামার ছান্দিক তালে তালে আরও একজন নারী ধান-চাল মাড়াই করতে সাহায্য করে। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া আর আলি দেওয়ার মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে ঘটতে পারে ছন্দপতন।
ঢেঁকি এখন দাদি-নানিদের স্মৃতির গল্পে পাওয়া যায়। ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে অনেকের হাতে আঘাত লেগেছে, আঙুল ভেঙেছে। পাড়াগাঁয়ে প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা যায় ঢেঁকিতে ধান ভেনে আটা তৈরির রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। তখন বধূরা ঢেঁকিতে কাজ করত রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। একসময় মানুষ ঢেঁকিতে ধান ও চাল ভেনে চিড়া-আটা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত হতো বাংলার জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ শোনা যায় না।
জীবননগর উপজেলার ১টি পৌরসভা, ৮টি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ গ্রামে এখন আর ঢেঁকির দেখা মেলে না। কালের বিবর্তনে ঢেঁকি এখন শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে। দিন দিন ঢেঁকি বিলুপ্ত হলেও একে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে সীমান্ত ইউনিয়ন ৯নং ওয়ার্ডের যাদবপুর গ্রামের শহিদুলের বাড়িতে ঢেঁকি দেখা যায়।
তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বাড়ির আশপাশের লোকজনের সুবিধার্থে গুঁড়ো তৈরি করার জন্য এ ঢেঁকি রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করার জন্য তার বাড়িতে আসেন অনেকে।
উপজেলার বাঁকা ইউনিয়নের মিনাজপুর গ্রামের ফুনু বেগম বলেন, বিয়ের পর থেকেই ঢেঁকি দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রবাদী মাড়াই করেছি। আগে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ঢেঁকিতে চালের আটা তৈরি করতে আসত। কিন্তু এখন আর তেমন কেউ আসে না। এখন সবাই মেশিনে চাল মাড়াই করে।
৪নং সীমান্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইশাবুল ইসলাম মিল্টন মোল্লা এ ব্যাপারে বলেন, আগামী প্রজন্ম যাতে বাংলার এসব সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলাবন্ধন স্থাপন করতে পারে, সেজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা জরুরি। তা না হলে বর্তমান প্রজম্মের ছেলে-মেয়েরা গ্রামের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে না।
খুলনা গেজেট/ টি আই