খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

অসহায় ও গরীবের বন্ধু মহানবী (সাঃ)

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

জীবন্ত আদর্শকোষ, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম । তার সম্পর্কে কথা বলতে গেলে হতে হয় নির্বাক, পৃথিবী হয় নিস্তব্দ, কালি হয় নিঃশেষ, কলম হয় অচল। কল্যাণ ও আদর্শের কি ছিল না তার মধ্যে ! তার কাছে এসে মিলিত হয়েছে আদর্শের সকল স্রোতধারা। হাজারো-লাখো পৃষ্টাতেও সংকুলান হবে না তার আদর্শের কাহিনী। কারণ, মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার প্রশংসায় বলেছেন, নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী (সূরা কলম:৪)। এই কারণে একজন আমেরিকান অমুসলিম বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হানড্রেড্স’ বইতে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকা তৈরি করেছেন। তাতে সবার শীর্ষে যার নাম দিয়েছেন তিনি হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ)। মহানবী (সাঃ) ছিলেন অসহায়, এতিম ও দূর্বলের বন্ধু।

নিঃস্ব, অসহায়, এতিম ও বিধবার প্রতি দয়া : নিঃস্ব, অসহায় ও এতিমদের প্রতি দয়ার শেষ ছিলনা মহানবী (সাঃ)-এর। কিভাবে গরীব মানুষের মুখে হাঁসি ফোটানো যায় এই জন্য সর্বদা ব্যাতিব্যস্ত থাকতেন। তিনি তাদেরকে খুব ভালোবাসতেন এবং সাহাবাদেরকেও ভালোবাসা ও দয়ার হাত প্রসারিত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে বলতেন, যদি কোন ব্যাক্তি কোন বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরিধান করাবেন। যদি কেউ কোন ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়ায় আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। আর যদি কেউ কোন পিপাসিতকে পানি পান করায় মহান আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের মোহরযুক্ত পানীয় পান করাবেন (আবু দাউদ, তিরমিজী)। আর এক হাদিসে নবীজি (সাঃ) এরশাদ করেন, আমি ও এতীমের তত্বাবধানকারী জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকবো। এ কথা বলার সময় তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল মিলিয়ে ইশারা করে দেখান (বুখারী:৫৫৭৯, তিরমিজী:১৯১৮)। নিঃস্ব বিধবাদের প্রতি সদয় হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে ব্যাক্তি বিধবা ও মিসকীনদের ভরণপোষণের চেষ্টা করে, সে আল্লাহর পথের জিহাদকারীর ন্যায়। অথবা সে ঐ ব্যাক্তির ন্যায় যে দিনে রোজা পালন করে ও রাতে (নফল ইবাদতে) দাঁড়িয়ে থাকে (বুখারী:৫৫৮০)।”

আর একটি ঘটনা আমরা সবাই জানি। একবার ঈদগাহে যাওয়ার পথে এক এতিম বাচ্চাকে কাঁদতে দেখে প্রিয় নবীজী তাকে আদর দিয়ে দুঃখ-দুর্দশার কথা জিজ্ঞেস করলেন। সব শুনে রসূল (সা.) তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে এলেন। গোসল করিয়ে সুন্দর কাপড় পরিয়ে ঈদগাহে নিয়ে গেলেন। এরপর তাকে বললেন, ‘হে বৎস! আমি যদি তোমার বাবা হই, আয়েশা যদি তোমার মা হয় আর ফাতেমা যদি তোমার বোন হয়, তাহলে কি তুমি সন্তুষ্ট?’ ছেলেটি খুশিতে জবাব দিলো, হ্যাঁ, অবশ্যই। এবার তার চেহারায় আনন্দের রেখা ফুটে উঠল। আজ লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায় এই মহান নবীর উম্মত দাবী করতে। আমাদের মধ্যে কি এর বিন্দু মাত্রও আছে?

অধীনস্তদের প্রতি সদাচরণ: কথায় বলে, তেলা মাথায় ঢালো তেল, রুক্ষ মাথায় ভাঙ্গো বেল। এ প্রবাদটির বাস্তবচিত্র আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অধীনস্ত চাকর-নকর, শ্রমিক-কর্মচারী এবং কাজের লোকদের সাথে আজ আমরা কেমন আচরণ করি? অথচ আমরা যার উত্তরসূরী হিসেবে গর্ব করি, সেই মহামানব মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শ কি আমরা মেনে চলি? হুজুর (সাঃ) তাঁর অধীনস্ত কাজের লোকদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল। চাকর-নকর, খাদেম ও শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের প্রতি ভালো ব্যবহারের তাকিদ দিয়ে মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেন, তারা তোমাদের ভাই ও তোমাদের খাদেম। মহান আল্লাহপাক তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব তোমাদের যার অধীনে তার ভাই আছে, তাকে তাই খাওয়ানো উচিত যা সে নিজে খায়, তাকে তাই পরানো উচিত যা সে নিজে পরে। সামর্থ্যরে বাইরের কাজের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। আর এ ধরনের কাজের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলে তবে তাদের কাজে তুমিও সাহায্য করো (বুখারি: ১৩৬০)। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি দশ বছর নবীজির খেদমত করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমার প্রতি উহঃ শব্দ বলেন নি। একথা জিজ্ঞাসা করেন নি তুমি এ কাজ কেন করলে এবং কেন করলে না (বুখারী:৫৬১২)। সোব্হানাল্লাহ, নবীজির কি আখলাক!

সীরাতুন্নবীর (সাঃ) শিক্ষা : ঈদ অর্থ আনন্দ; আর মিলাদুন্নবী অর্থ নবীর জন্ম। নবীর জন্ম উপলক্ষ্যে যে আনন্দ কর্মসূচী তাকেই বলা হয় ঈদে-মিলাদুন্নবী। তবে এটাকে সীরাতুন্নবী বলাই অধিক অর্থবহ। পৃৃথিবীতে সুমহান আদর্শ ও উন্নত আখলাক প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইংরেজী ৫৭০ সনে এবং আরবী ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল মাসের ৯ কিংবা ১২ তারিখ সোমবার বিশ্ব-মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করেন। মহানবী (সাঃ)-এর সুন্নত ও মহাব্বত সাহাবায়ে কেরামের অস্থি-মজ্জা ও অন্তরে বদ্ধমূল ছিলো। যার কারণে রসুলের জন্ম দিনকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ দিবসে কোন কর্মসূচীর আয়োজন তারা করেননি। তারা সারা বছরই হুজুরের প্রশংসা করেছেন এবং তার ও তার পরিবারের ওপর দরুদ ও সম্মান জানানোকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও বরকতের ওসিলা হিসেবে মনে করেছেন। মহানবীর চরিত্র ও আদর্শের কথা লিখে কখনও শেষ করা যাবে না। তিনি যেন এক ‘জীবন্ত আদর্শকোষ’। তাকে আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে কুরআনে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ (সুরা আহজাব: ২১)। তাই আসুন, আমরা শুধুমাত্র মিষ্টি খাওয়া, র‌্যালী-করা, আর একটি নির্দিষ্ট দিনে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে সারাবছরই মহান নবীর মহান আদর্শের আলোচনা অব্যাহত রাখি এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তার আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়ে এক সুস্থ সমাজ গড়ি। আমীন।

(লেখক: জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, ফিসারিজ ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

খুলনা গেজেট / এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!