দিন দশেক আগেই খোদ অমিত শাহ বলেছিলেন, বঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির যে দাবি বিজেপি নেতারা করছেন, তা ‘ন্যায়সঙ্গত’। দিল্লিতে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে শাহের বৈঠক সেই রাষ্ট্রপতি শাসন নিয়ে জল্পনা উস্কে দিল। শাহের বাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক সেরে বেরিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে চোখা চোখা বিশেষণে নিশানা করেছেন রাজ্যপাল। সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ‘রাজ্যে কার্যত নৈরাজ্য চলছে’, ‘সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে’, ‘আল-কায়দা দাঁত-নখ ছড়াচ্ছে’ থেকে ‘পুলিশ-রাষ্ট্রের মতো পরিস্থিতি’, ‘শীর্ষ আইএএস-আইপিএসেরা প্রথম সারির রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করছেন’-এর মতো মন্তব্য করেছেন।
রাজ্যপালের ওই সব মন্তব্যকে প্রত্যাশিত ভাবেই সমর্থন করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তৃণমূল নেতৃত্বের পাল্টা বক্তব্য, রাজ্যপাল বিজেপির ভাষাই বলছেন। জনগণই এর জবাব দেবেন।
শাহের সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে, তা অবশ্য রাজ্যপাল সরাসরি বলতে চাননি। কিন্তু সূত্রের খবর, বৈঠকের পরে তিনি যে ভাষায় রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও সেই কথাই জানিয়েছেন। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষপদে বর্তমান কর্তারা থাকলে ‘নিরপেক্ষ ভাবে’ বিধানসভা ভোট করানো যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে জানিয়েছেন। সে দিকে ইঙ্গিত করে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যপাল মন্তব্য করেন, ‘‘কে নির্বাচিত হল, সেটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। কী ভাবে নির্বাচন হল, সেটা বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে কাজে লাগাচ্ছেন।’’
বিজেপি নেতারা বেশ কিছু দিন ধরেই কেন্দ্রের কাছে বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি জানাচ্ছেন। বিজেপি নেতা হিসেবে শাহ সেই দাবি ন্যায়সঙ্গত বললেও, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বলেছিলেন, ‘‘কেন্দ্রকে সংবিধান অনুযায়ী পরিস্থিতি বিচার করবে হবে। রাজ্যপাল কী রিপোর্ট দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’’ দিলীপ ঘোষ এ দিন রাজ্যপালের মন্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, “বিজেপি নৈতিক ভাবে রাষ্ট্রপতি শাসনের পক্ষে নয়। গণতান্ত্রিক ভাবে ভোটে লড়ে জেতার পক্ষে এবং পশ্চিমবঙ্গে সেই ক্ষমতাও আমাদের আছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ না-থাকলে এমন পরিস্থিতি আসবে। তখন আমরা ভেবে দেখব।’’
যার জবাবে লোকসভায় তৃণমূলের সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তারাই রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করার মতো পদক্ষেপের কথা ভাবে। তবে বাংলা শক্ত ঘাঁটি। রাজ্যের মানুষই বিজেপিকে উপযুক্ত জবাব দেবেন।’’
রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ভোটে গেলে মমতা সহানুভূতির ভোট পেয়ে যেতে পারেন বলে ধারণা বিজেপি নেতাদেরই একাংশের। আবার মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা পদে থাকলে সুষ্ঠু ভাবে ভোট হবে কি না, সেই আশঙ্কাও রয়েছে তাঁদের মধ্যে। রাজ্যপাল এ দিন রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁকে ‘ডিজি-র সুপার বস’ বলে কটাক্ষ করেন। প্রশান্ত কিশোরের নাম না-করে বলেন, ‘ক্ষমতার করিডর নন-স্টেট অ্যাক্টরে ভরে গিয়েছে’। রাজনৈতিক হিংসা, আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ, পুলিশ-প্রশাসনের দায়বদ্ধতার অভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলে রাজ্যপালের মন্তব্য, ‘‘একে যদি বানানা রিপাবলিকের পুলিশ-রাষ্ট্র না বলা হয়, তা হলে কী বলা হবে?’’
রাজ্যপালের সুরেই দিলীপও এ দিন ফের অভিযোগ করেন, এ রাজ্যে মানুষের কথা বলার, পছন্দমতো রাজনীতি করার অধিকার নেই। সরকার হিংসার নীতি নিয়ে চলছে আর পুলিশ-প্রশাসন তাতে মদত দিচ্ছে। পুজোর মধ্যেও বিজেপি কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তো বটেই, এমনকি, তৃণমূল কর্মীদেরও মিথ্যা মামলায় আটকে রাখা হচ্ছে। যাতে তাঁরা দল ছাড়তে না-পারেন। দিলীপের প্রতিশ্রুতি, ‘‘গণতন্ত্র ফেরানোর লড়াইয়ে আমাদের ১২০ জন কর্মী প্রাণ দিয়েছেন। প্রয়োজনে আরও ১২০ জন প্রাণ দেবেন। কিন্তু রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন করবই। আর ক্ষমতায় এলে যে দলেরই হোক, রাজনৈতিক কর্মীদের মিথ্যে মামলা থেকে মুক্তি দেব।’’
রাজ্যপালকে ‘রাজভবনের কলঙ্ক’ এবং ‘বিজেপির লাউডস্পিকার’ আখ্যা দিয়ে কল্যাণের প্রশ্ন, “রাজ্যপাল কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, না বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে? এর আগে অন্তত ৯৯ বার একই কাজ করেছেন। মিথ্যায় ভরা আবর্জনা নিয়ে ১০০তম বার দিল্লি গিয়েছেন।’’ খবর আনন্দবাজার পত্রিকা।
খুলনা গেজেট/এনএম