যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের মেয়র শহরে আরো ১৫ দিন জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দিয়েছেন। মেয়র মুরিয়েল বাউজার বলেছেন, “অনেকেই অস্ত্রসহ এখানে এসেছেন সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিতে। তারা অস্ত্রের পাশাপাশি রাসায়নিক, ইট এবং বোতলও নিক্ষেপ করেছেন।” জরুরি অবস্থার ঘোষণার ফলে ওয়াশিংটন ডিসির নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য কারফিউ দেয়া, জরুরি পণ্য সরবরাহের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিত পারবে শহর কর্তৃপক্ষ। ২১ জানুয়ারি দুপুর ৩টা পর্যন্ত এই ঘোষণা বলবত থাকবে। স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত শহরে কারফিউ জারি রয়েছে।
এর আগে ক্যাপিটল হিলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা সিনেটরদের জিম্মি করতে চেয়েছিল। এজন্য তারা কমান্ডো স্টাইলে সেখানে হামলা চালায়। এ সময় সিনেটররা প্রাণ বাঁচাতে সুড়ঙ্গ পথ ব্যবহার করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে জনরায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনটা বলা হচ্ছে বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ায়।
আগস্টে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি নির্বাচিত হন তাহলে আমাদের গণতন্ত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। এরপর ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত কমালা হ্যারিস জয়ের পরে প্রথম বক্তব্যে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র গ্যারান্টেড নয়। তাদের দু’জনের কথার গুরুত্ব কতটা তা ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রতো অবশ্যই, সারাবিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জনগণের রায়কে মানবেন না এমন আভাস নির্বাচনের আগেই দিয়েছিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টে ফয়সালার কথা বলেছিলেন। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি অভ্যুত্থান শুরু করেছিলেন। গোপনে তা চালিয়ে গেলেও নির্বাচনের পর তা প্রকাশ্য হতে থাকে।
ট্রাম্প জনরায় না মেনে গায়ের জোরে নির্বাচনের ফল উল্টে দেয়ার চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেন। সর্বশেষ তারই পরিণতিতে বুধবার কমপক্ষে ২০০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে পদদলিত করেছেন তিনি ও তার সমর্থকরা। এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতারা। তিনি মানুষের অধিকারকে পদদলিত করেছেন। নেতাকর্মীদের উস্কে দিয়েছেন ক্যাপিটল হিলে হামলা চালাতে। সেখানে চারটি প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যানড্রু কুমো এ ঘটনাকে ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের ব্যর্থ অভ্যুত্থান বলে আখ্যায়িত করেছেন। এজন্য তিনি ট্রাম্প প্রশাসনকে অযোগ্য, নিষ্ঠুর ও বিভক্তি সৃষ্টিকারী হিসেব আখ্যায়িত করেছেন। সারাবিশ্বে নেতারা ট্রাম্পের এমন কর্মকাণ্ডের কড়া নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হলো গণতন্ত্রের আঁতুরঘর। সেখানে এভাবে গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করা মোটেও উচিত নয়।
বাইরে তখন তন্ডব চালাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা, ভিতরে ক্যাপিটলের সব প্রবেশদ্বার বন্ধ। দরজার দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা। যে কোনও সময় দরজা ভেঙে ঢুকে পড়তে পারে উগ্র সমর্থকরা। শেষমেশ গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে নিরাপদে ঘরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হল সিনেটরদের। বুধবার (আমেরিকান সময় অনুযায়ী) এমনই নজিরবিহীন রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় পরিস্থিতি দেখল আমেরিকার কংগ্রেস। এখবর দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ভিতরে চলছে ভরা সভা। ভারতের সংসদ ভবনের মতোই চুল চেরা বিতর্কে মগ্ন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা,রয়েছেন সাংবাদিকরাও। ঘটনাচক্রে এই আলোচনার শেষেই ইলেক্টরাল কলেজের ভোটের হিসেবে সরকারিভাবে জো বাইডেন নির্বাচিত হবেন। ট্রাম্পের রিপাবলিকান সিনেটররা এখনও কার্যত পরাজয় মেনে নিতে নারাজ। আলোচনা, বিতর্ক, প্রশ্নোত্তর-এর মধ্যেই চলছে কটাক্ষ, টিকা-টিপ্পনি। তার মধ্যেই বাইরে হই হট্টগোল। কয়েক হাজার জনতার চিৎকার। তাদের গতিমুখ ক্যাপিটল ভবন। ক্যাপিটলের নিরাপত্তারক্ষীরাও তাদের আটকাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই গণ্ডগোলের খবর তখন পৌঁছে গিয়েছে ভিতরেও।
সিনেটররাও বাইরের দিকে উঁকিঝুঁকি মারছেন বাইরে ঠিক কী হয়েছে, বোঝার জন্য। আমেরিকার ইতিহাসে এমন ঘটনা কোনও দিন ঘটেনি। ফলে তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কী হয়েছে। তখনও ততটা ‘সিরিয়াসলি’ নেননি সিনেটররা। কিন্তু বিষয়টা যে ট্রাম্প সমর্থকদের ‘হামলা’ সেটা স্পষ্ট হয় যখন একের পর এক দরজা সজোরে বন্ধ করে দিচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। পর পর ভেঙে পড়ছে দরজা-জানালার কাচ। ট্রাম্পের রিপাবলিকান সিনেটরদের দিকে কটাক্ষ ছুড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ- ‘ডাকুন আপনার নেতাকে! ওর জন্যই তো এ সব হচ্ছে।’
কিন্তু বিষয়টা যে ভয়ানক, সেটা সিনেটররা টের পেলেন আরও কিছুটা পরে। ক্যাপিটলের মূল দরজা শুধু বন্ধ করাই নয়, ভিতর থেকে আসবাবপত্র রেখে সাপোর্ট দিয়ে দিয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ফ্লোর ডিরেক্টর কেইথ স্টার্ন বলেন, ‘প্রত্যেকে নিজের নিজের আসনে বসে পড়ুন। শান্ত থাকুন।’ এর মধ্যেই বাইরে কাঁদানে গ্যাসের মতো কিছু একটা ছোড়া হয় হামলাকারীদের আটকানোর জন্য। এবার ঘোষণা, ‘সিটের নীচে রাখা গ্যাস মাস্ক পরে নিন সবাই’। যে কোনও সময় যে কোনও দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে পারে বাইরের আতঙ্ক। গোড়ার দিকে যেটা ছিল কৌতূহলের বিষয়, সেটাই হয়ে দাঁড়াল বিভীষিকা।
শেষ পর্যন্ত আর ঝুঁকি নেননি ক্যাপিটলের নিরাপত্তা অফিসাররা। সিনেটরদের বললেন, সুড়ঙ্গ দিয়ে নিরাপদ কক্ষে পৌঁছে যেতে। সেভাবেই ফাঁকা করা হল ক্যাপিটল। হাউস সার্জেন্টকে কোনও এক নিরাপত্তা অফিসারকে নির্দেশ দিতে শোনা যায়, ‘ক্যাপটলকে আমরা যেন নিরাপদ রাখতে পারি, সেটা নিশ্চিত করুন।’ সব মিলিয়ে, রুদ্ধশ্বাস এক নাটকের সাক্ষী থাকল ক্যাপিটল এবং সিনেটররা।
খুলনা গেজেট / এমএম