বছর ঘুরে এলো পবিত্র ঈদুল আযহা। যেটা আমাদের কাছে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর মুসলমানরা ২য় বারের মত করোনার মধ্যে ঈদুল আযহা পালন করছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা সারা বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু ভয়াবহ করোনার কারণে সেই আনন্দ অনেকটা মলিন।
তারপরও ঈদ বলে কথা। সমগ্র পৃথিবীর মত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঈদ আনন্দের প্রস্তুতি চলছে। আর পবিত্র ঈদুল আযহার অন্যতম শিক্ষা মহান আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করা। আমার কাছে এই কোরবানির ঈদটি এবছর অন্যরকম হয়ে এসেছে। এই প্রথম আমার পিতা আমাদের অভিভাবক সাহিত্যেক মরহুম শেখ আবদুল জলিল ছাড়া আমাদের পরিবার কোরবানির ঈদ পালন করতে যাচ্ছে। আমাদের আব্বা গত বছর (২০২০) সালের ১৭ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। আব্বাকে হারিয়ে আমি অনেকটা দিক হারিয়ে ফেলেছি। আম্মা ও আমার মরহুম দাদার কাছে গল্প শুনেছি আব্বা যখন থেকে চাকরি শুরু করেছেন তখন থেকেই কোরবানি দেয়া শুরু করেন। আর চাকরিরত অবস্থায় কখনো কোরবানি করা থেকে বিরত থাকেননি। আব্বা আমাকে আমার ভাই বোন ও আমার ছেলেকে কোরবানি দেয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আব্বা বলতেন সামর্থ্য থাকলে কোরবানি দিতেই হবে। আমি যখন থেকে আয় করতে শিখেছি তখন থেকেই কোরবানি দেয়া শুরু করি।
আমার মরহুম পিতার ডায়েরি লেখার অভ্যাস সেই ১৯৫০ সাল থেকে। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তার একটি দিনও ডায়েরি লেখা বাদ যায়নি। আব্বার ডায়েরি দেখলে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে আমাদের কোরবানির পশুটি কেমন ছিল বা কোরবানির সকল তথ্য। ১৯৯৯ সালের ডায়েরি খুললে পাওয়া যাবে ঐ বছর কত তারিখে ঈদুল আযহা ছিল। কত টাকা দিয়ে গরু কেনা হয়েছিল। কার কার তরফ হতে আল্লাহর নামে কোরবানি দেয়া হয়েছিল। কতটুকু মাংস হয়েছিল। আর কতটুকু আত্মীয় ও অন্যদের মধ্যে বন্টন বা দান করা হয়েছিল। গরু বানানো মুজরি কত ছিল। অন্য খরচ কত ছিল।
এককথায় সব পাওয়া যাবে ডায়েরিতে। একেবারে সব গুছানো। মূলত: আব্বা ধর্মের সব বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করতেন। আব্বাকে ছাড়া তাই পবিত্র ঈদুল আযহা আমাদের কাছে তেমন আনন্দদায়ক নয়। আর কেউ ডেকে বলবেন না আমার কাছে একটু বস। কাগজ ও কলম নেও। আমি যা বলি লেখ। গরুর দাম কত। আনা নেওয়া খরচ কত। গরুর খাওয়া খরচ কত। গরু বানাতে খরচ কত। তোমার আম্মা ও মুন্নী (আমার স্ত্রী) মাংস বিতরণের যে তালিকা করেছে তা আমাকে দেখাও। হয় বলতেন সব ঠিক আছে, না হলে বলতেন এই এই নাম বাদ পড়েছে। এগুলো তালিকায় উঠাও।
এইবার ঈদে আর কেউ খুটিনাটি এসব বিষয়ে জানতে চাইবেন না। খবর নিবেন না আমার সন্তান বৌমা ঢাকা থেকে কবে আসবে। আমার ছোট ভাই ও তার পরিবার ঈদে খুলনায় আসবে কিনা। একমাত্র বোন শিক্ষিকা নিলুফার সুলতানা রিনি ও তার জামাইকে খবর দেও। আর কেউ তো বলার নেই। আব্বা প্রতিবার ঈদের সময় আমার হাতে গোপনে কিছু টাকা দিতেন। বলতাম কি জন্য। উত্তর দিতেন রাখো কাজে লাগবে। এই কাজটি এবার আম্মা করেছেন।
আব্বার যতদিন চলাচলের শক্তি ছিল আমার একমাত্র সন্তান ইন্জিনিয়ার শেখ শাহনেওয়াজ শরীফ অভি ছোট ভাই ডাক্তার শেখ মাহমুদুল হাসান মুক্তা আমরা একসাথে ঈদের জামাতে যেতাম। করোনার কারণে ছোট ভাইটাও দূরে। আববা গত বছর ঈদুল আযহার আগে থেকেই অসুস্থ হয়ে যান। তারপরও আমাদের গরুটি যেখানে কোরবানি হয় এবং গরু বানানো চলছিল সেখানে লাঠি ভর দিয়ে যেয়ে কিছু সময় চেয়ারে বসে গরু বানানো দেখেন। সেই আব্বাকে ছাড়া আমাদের পরিবারের ঈদুল আযহা পালন হতে যাচ্ছে। একই সাথে আমার ভাই আমার বিয়াই কাজী মোজাফফর হোসেন গত বছর ৮ আগষ্ট ও আমার বোন বেয়াইন মর্জিনা খাতুন চলতি বছর ১৫ জুন ইন্তেকাল করেছেন।
এই আপন তিন জনকে হারিয়ে এবারের ঈদুল আযহা আমার কাছে অন্যরকম ঈদ। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার মরহুম পিতা ও বিয়াই-বেয়াইনকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন।
(লেখক : সাংবাদিক ও অধ্যাপক, খুলনা প্রতিনিধি, ইউএনবি)
খুলনা গেজেট/ টি আই