শিক্ষকদের কর্ম বিরতির কারণে দেশের অন্যতম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)’র শিক্ষা কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ক্লাস এবং পরীক্ষা সমূহ বন্ধ রয়েছে। পরীক্ষা ও ভর্তি সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রয়েছেন শিক্ষকেরা। বিরত রয়েছেন একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম থোকেও।
দাবি আদায়ে গত তিন মাস ধরে চলে আসা আন্দোলন সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ১ জুলাই থেকে এ আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের কর্ম বিরতিতে রূপ নেয়। কর্মবিরতির পাশাপাশি প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে চলছে অবস্থান কর্মসূচি। অবস্থান কর্মসূচিতে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড কার্যকর এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
এদিকে একই দাবিতে কুয়েট কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতি পৃথকভাবে ১ জুলাই থেকে কর্মবিরতি এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার কেন্দ্রের বারান্দায় অবস্থান কর্মসূচি থেকে নেতৃবৃন্দ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এদিকে কুয়েটের শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়াল সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র গোলাম রব্বানী বলেন, স্যারদের ক্লাস বর্জন স্যারদের দাবি আদায়ের জন্য। আসলে ক্লাস বর্জন আমাদের জন্য অনেক ক্ষতিকর। শ্রেণিকক্ষে আমাদের সিডিউল অনুযায়ী লেখাপড়া, সেটি বিঘ্নিত হচ্ছে প্লাস অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি এখনই দাবি মেনে নেয় এবং এখনই যদি ক্লাস শুরু হয় সেক্ষেত্রে অনেকে বাড়ি চলে গেছে। তাদের আসা যাওয়ার একটা সমস্যা হবে। আমরা আশা করি যত দ্রুত সম্ভব সরকার শিক্ষকদের দাবি মেনে নিবেন এবং আমাদের শিক্ষাক্রম আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে। কারণ আমরা এরকম বিরান কুয়েট চাই না। কুয়েটের ক্লাস চালু হোক, লেখাপড়া, ল্যাব আবার চালু হোক।
তিনি বলেন, আমাদের সেমিস্টার শেষ। পরীক্ষা দেরিতে হলে রেজাল্ট দিতেও দেরি হবে। আমরা চাই না এমন কিছু হোক। আমরা চাই পূর্বের মতো কুয়েট।
মোঃ হাসানুল হক নামে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ১ জুলাই থেকে স্যারেরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন শুরু করেছেন, এজন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। স্যারদের যে দাবি সেটা যৌক্তিক। সরকার এটা বিবেচনা করে দ্রুত চেষ্টা করুক সমাধানের জন্য। এতে করে আমাদের উপকার হবে স্যাররাও খুশি হবে। স্যাররা যাতে খুশি থাকে আর আমাদেরও যাতে ক্লাস কন্টিনিউ হয় আমরা সেটাই চাই।
মাহি নামের সিইসি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস বন্ধ হওয়ার কারণে আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে একাডেমিক যে সিডিউলটা দেওয়া হয়েছে ওটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে ক্লাস এখন হওয়ার কথা ছিল সেটা কয়েকদিন পরে হবে। রুটিন অনুযায়ী আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা যেটা হওয়ার কথা ছিল, একাডেমিক যে রুটিন ছিল সেটা ব্যর্থ হবে। ফলে আমরা পিছিয়ে যাবো।
সাইফুল ইসলাম নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কারণে আমাদের একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষকদের আন্দোলন কবে শেষ হবে, ক্লাস আবার কখন শুরু হবে! কিছুই বুঝতে পারছি না। শিক্ষকদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা অবশ্যই আছে।
আমাদের দাবি হচ্ছে শিক্ষকদের যে দাবি এটা মেনে নিয়ে আমাদের যাতে দ্রুত ক্লাস শুরু হয়, স্বাভাবিকভাবে ক্লাস করতে পারি, পরীক্ষা দিতে পারি এটাই সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস বন্ধ হওয়ার ফলে যেহেতু আমাদের সেমিস্টারের শেষের দিকে, পরীক্ষা হয়তো পিছিয়ে যাবে। সেমিস্টার পরীক্ষাটা দেরি হলে ৪ বছর পর আমাদের বেরোতে একটু দেরি হইতে পারে। স্যারদের আন্দোলনেও যৌক্তিক। সরকারের উচিত এটা দ্রুত সমাধান করা। তাহলে আমাদের অসুবিধা হলো না, সময় ক্ষেপণ হবে না। আমাদের সম্মানিত যারা শিক্ষক আছেন তাদেরও সুবিধা হলো। এটা যত দ্রুত সমাধান হবে তত আমাদের জন্য ভালো।
এদিকে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের শিক্ষকেরা। কর্ম বিরতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেলা ১২ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল হাসিবের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ আলমগীর হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ অবস্থান কর্মসূচিতে নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তৃতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. এম এম এ হাসেম, প্রফেসর ড. মোঃ আবু ইউসুফ, প্রফেসর ড. মোহান্মদ আরিফুল ইসলাম, প্রফেসর ড. হেলাল- আন- নাহিয়ান, পলাশ সাহা প্রমূখ।
অবস্থান কর্মসূচিতে দেওয়া বক্তৃতায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল হাসিব বলেন, দাবি আদায়ে গত তিন মাস ধরে আমরা আন্দোলন করে আসছি। আমরা মানববন্ধন করেছি, কালো ব্যাচ ধারন করেছি, মৌন মিছিল করেছি, বিবৃতি দিয়েছি, সংক্ষিপ্ত আকারে কর্মবিরতি পালন করেছি। তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আমাদের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। ২৫, ২৬, ২৭ জুলাই আমরা অর্ধ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছি। ৩০ জুন সারাদিন আমরা পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছি। তারপরও আজ পর্যন্ত আমাদের সাথে সেই ভাবে যোগাযোগ করা হয় নাই। আমাদের যে দাবি আছে সেটা সুরাহার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আশার কথা বলা হয়নি। শিক্ষক মানুষ আমরা কখনো রাস্তায় যেতে চাই না। আমরা চাই ক্লাস রুমে থাকতে, আমরা চাই রিসার্সের মধ্যে থাকতে, আমরা চাই শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-প্রদানের মধ্যে থাকতে। সরকারের যারা নীতি নির্ধারক আছেন, আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাতে চাই আমাদের যে দাবি আছে ন্যায্য দাবি এটা মেনে নিন। প্রত্যয় স্কিম যেটা চালু করা হয়েছে সেটা প্রত্যাহার করুন। আমাদেরকে কাজে ফিরিয়ে যেতে দিন। সরকারের নীতি নির্ধারক কিংবা অন্য যারা আছেন তাদের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের যে দাবি আছে সেটা অনতিবিলম্বে মেনে নিবেন, অন্যথায় আমাদের কর্মসূচি আরও কঠোর থেকে কঠোরতর হবে।
অবস্থান কর্মসূচিতে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা যে তিনটা দাবি করেছিলাম যে, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা স্কিম প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং আমাদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল। এই ৩ টা দাবি যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে ১ জুলাই থেকে আমরা সর্বাত্মক কর্ম বিরতিতে যাবো। তারই ফলশ্রুতিতে ১ জুলাই থেকে আমরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করি। কর্মবিরতির মধ্যে আমাদের এখানে কোন রকম ক্লাস পরীক্ষা অন্যান্য একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। শুধু কুয়েট নয় সারা বাংলাদেশে ৩৫ টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে না নেওয়ায় আমরা ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতির কর্মসূচি নেই। সাথে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। তিনি বলেন আমাদের দাবি দাওয়া যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে আমাদের এ কর্ম বিরতির কর্মসূচি সামনে আরো কঠোরভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেবো।
এদিকে একই দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার কেন্দ্রের বারান্দায় অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচিতে সমিতির নেতৃবৃন্দ তাদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম