নীরবে চলে গেলেন তিনি। কেউ জানলো না, কেউ বুঝলো না, আমরা কী হারালাম, কাকে হারালাম!
তাঁর লেখা, তাঁর কর্ম সামনে এলেই হয়তো কেউ কেউ স্মৃতির জানালা দিয়ে একটু একটু চেয়ে দেখবে। মানুষ এমনই হয়। আমরা কেউ কাউকে বেশিদিন ধরে রাখি না।
আজকাল বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকি। মনটা পড়ে থাকে খুলনায়। সেখানে অনেক ভালবাসার বসবাস। সকল ভালবাসার টানে মাঝে মাঝে খুলনায় চলে যাই। খুলনায় আমার অকৃত্রিম ভালবাসার মাঝে এক শ্রদ্ধার বসবাস ছিল। তাঁর অদৃশ্য আকর্ষণ আমি ঢাকায় বসেও অনুভব করতাম। তাইতো সুযোগ পেলেই ছুটে যেতাম সেই অদৃশ্য টানে।
সেদিন ছিল নভেম্বর ১২, ২০২২ । ঢাকায় বসে খুলনা টান অনুভব করলাম। গিন্নীর শত বাধা তুচ্ছ করে ছুটে গেলাম খুলনায়। সেখানে একলা ঘরে শুয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা করছিলাম। রাত তখন গভীর। হঠাৎ মোবাইল ফোনে ঢাকা থেকে অসিতবরণ স্যারের এক ভক্ত স্নেহের অন্বেষা কল করে বললো,
– দাদা ভাইয়ের কোন খবর জানেন? তিনি মারাত্মক অসুস্থ।
আমার মাথার ভিতর একটা কল্পিত ভয় ঢুকে গেল। ভাবলাম এত রাতে কার কাছে খবর নেবো। কোন উপায় না পেয়ে শেষমেশ স্যারের মোবাইলে ফোন করলে ধরলেন স্যারের সহধর্মিণী। তাঁর সাথে কথা বলে আমার বুঝতে কিছু বাকি রইলো না। হয়তো এই রাতই শেষ রাত। সকালে ঘুম থেকে উঠে সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম- তিনি শেষ নিদ্রায়। ১৩ নভেম্বর ভোররাতে তিনি চলে গেছেন। হাসপাতাল থেকে তাঁকে নিয়ে দিন ব্যাপি নানা নিয়ম কানুন সেরে সন্ধ্যায় শ্মশানে চিতায় শুইয়ে দিয়ে শেষ শরীরী চিহ্ন দেখা পর্যন্ত পাশে বসে রইলাম। শ্মশানের চিতা পানিতে ধুঁয়ে শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। তাঁর শরীরী বিদায় হলেও আমার চিত্তের মাঝে রোপিত হলো স্যারের মহান আদর্শের নতুন বৃক্ষ।
স্যারের চলে যাওয়ার আগের দিন আকস্মিকভাবে কেন আমি ঢাকা থেকে খুলনায় গিয়েছিলাম তার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার আরো একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। প্রয়াত বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ স্যারের মরদেহ যেদিন আমেরিকা থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল তার এক মাস আগেই আমি ছিলাম জাতিসংঘ শান্তি মিশন দারফুর, সুদানে। ছয় মাসের আগে আমার দেশে আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ স্যারের মরদেহ দেশে আসার দুই দিন আগে আকস্মিকভাবে আমাকে দেশে আসতে হয়েছিল। সেই সুবাদে আমি তাঁর কফিনটি শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিলাম এবং নুহাশ পল্লীতে গিয়ে তাঁর শেষ বাড়িটি ছুঁতে পেরেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে এই দু’জন মহান মানুষের শেষ বিদায় হয়েছিল ১৩ নভেম্বর।
ঠিক একইভাবে অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ স্যারের চলে যাবার আগের দিন আমাকে আকস্মিকভাবে খুলনায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল ও হাসপাতালের বিছানা থেকে শ্মশান পর্যন্ত স্যারের সাথে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ খুলনার কিছু গুণী মানুষ সাত দিন ব্যাপি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন। সেইসব স্মরণ সভার একটিতে আমি হাজির থেকে নিজেকে ধন্য করেছিলাম। আমার মনের মাঝে বিশাল স্থান দখল করে থাকা এই দু’জন মহান মানুষের শেষ বিদায়ের সময় আকস্মিক উপস্থিতি সারাজীবন বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে।
অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ স্যারের সাথে আমার জীবনের স্মৃতি লিখতে হলে কয়েকটি বই হয়ে যাবে অথবা আমার লেখার হাত শেষ হয়ে যাবে; তবু তাঁর আর আমার কাহিনী লেখা ফুরাবে না।
এইতো কয়েক মাস আগের কথা। খুলনা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে একটা পার্সেল এলো। আমি একটু আগ্রহ নিয়ে পার্সেলটি খুলে দেখি ভিতরে কয়েকটি বই। বইটি ছিল একটি অনুবাদ গ্রন্থ। নাম- ‘প্রেম ও দ্রোহের গল্প’। লেখক খলিল জিবরান। অনুবাদক- অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ। বইটি হাতে পেয়ে পাতা উল্টাতে থাকলাম। অসাধারণ কভার ও সাজসজ্জার সাথে একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম। একখানে স্যারের নিজ হাতে সেই পরিচিত লেখা-
‘সব ক্ষয়ক্ষতি শেষে রবে শুধু খেয়াচিহ্নহারা এপারের ভালবাসা’
-রবীন্দ্রনাথ
পরের পৃষ্ঠা উল্টাতে যা দেখলাম তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে লাগলো। বার বার পড়েও মনে হলো ভুল পড়লাম নাকি।
এক সময় আমার চোখের পাতা ভিজে গেল। বার বার মনে করতে লাগলাম- এই বইটি স্যার যে কামরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছেন সেই কামরুল ইসলাম আমি কি না। ভাল করে পড়ে দেখলাম এ এম কামরুল ইসলাম লেখা আছে। নামের আগে ‘এ এম’ দিয়ে লেখা কোন কামরুল ইসলামকে আমার জানা নেই। তাই কিছুটা বিশ্বাস হলো। স্যারের কাছে মোবাইল করতে গিয়েও বার বার হাত কাঁপলো। কিছু সময় দম নিয়ে এক পর্যায়ে স্যারের কাছে কল দিলাম। তিনি ফোন ধরেই বললেন,
-তোমাকে কয়েকটি বই পাঠিয়েছি। তুমি পেয়েছো?
-জী স্যার। কিন্তু এই বইটি যে কামরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছেন সে কি আমি?
-অবশ্যই তুমি।
আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে কিছু সময় চুপ করে রইলাম। চোখের কোণে আবারও হালকা পানি এলো। মোবাইলের ওপার থেকে স্পষ্ট অথচ মৃদু কান্নার শব্দ আমার কানে এলো। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ওপার থেকে কান্না সংবরণ করে স্যার বললেন,
– আমার প্রকাশক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ,
-কে এই কামরুল ইসলাম। তিনি কি করেন, কোথায় থাকেন ইত্যাদি। আমি বলেছি -এই কামরুল ইসলাম আমার ছাত্র। আবার কখনও কখনও আমি কামরুল ইসলামের ছাত্র।
স্যারের কথা শেষ হলে আমার কান্না শুরু হলো। এভাবে পরস্পরের আনন্দের কান্নাকাটিতে আরো কিছু সময় কেটে গেল। অবশেষে আমার বিশ্বাস হলো -এই বইটি যাকে উৎসর্গ করা হয়েছে সেই অধম স্বয়ং আমি। উৎসর্গের পাতায় ছাপার অক্ষরে যা লেখা ছিল তা হুবহু তুলে ধরছি।
এ এম কামরুল ইসলাম
শুভ কর্মপথে নিরন্তন এগিয়ে
চলাতেই তার প্রাণের স্ফুর্তি,
চিত্তের অভ্যুদয় ও আত্মার মুক্তি।
আমার নামে বইটি উৎসর্গ করে যে কথাগুলি তিনি লিখেছিলেন তার মানে বুঝার ক্ষমতা আমার নেই। অতএব বইটি আমার নামে উৎসর্গ করে স্যার অপাত্রে কন্যা দান করেছেন বলে আমার মনে হলো। স্যারের এই দান আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
আমার চাকরি জীবনের শেষ দিনে খুলনার অনেক সংগঠন ও ব্যাক্তি বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। সেইসব আয়োজনে বিভিন্ন গুণী মানুষের বক্তব্য শুনে আমি বিমোহিত হয়েছিলাম। খুলনার ডুমুরিয়ায় ‘সোনামুখ পরিবার’ কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে নিয়ে কিছু বাণী উচ্চারণ করেছিলেন।
সোনামুখ পরিবার, বয়রা, খুলনা শাখা থেকে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ স্যারের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পেরে তাঁর বক্তব্য লিখে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর লেখাটি ঐ অনুষ্ঠানে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন অধ্যাপক জগলুল কাদের। সেই লেখাটি এখানে হুবহু তুলে ধরলাম।
এই লেখাটি তিনি তাঁর ফেসবুক ওয়ালেও লিখেছিলেন।
প্রিয় কামরুল ইসলামের চাকরি-জীবনের সমাপ্তিতে শুভেচ্ছা
গতকাল ছিল কামরুলের চাকরি-জীবনের শেষ দিন।ডুমুরিয়ায় আমরা মিলিত হয়েছিলাম তার সেই জীবনের সফল পরিসমাপ্তিতে। আজ তার জন্মদিন। একই আকাশে যেন অস্ত ও উদয় দেখছি। দুটিই রমণীয়। কামরুল খাঁটি কাজপাগল। ও কাজ ছাড়তে চাইলেও কাজ ওকে ছাড়বে না।ভারতে বহু যোগী আছেন যারা জ্বলন্ত কয়লার গনগনে আগুনের উপর দিয়ে দিব্বি হেঁটে যেতে পারেন, এতটুকু অগ্নিদগ্ধ না হয়ে। যোগীদের পক্ষে এটা সম্ভব। কিন্তু কামরুল যোগী না হয়েও তার অটল সততা,বিরল কর্তব্যনিষ্ঠা ও দুর্লভ সাহসিকতা অন্তরে লালন করে এতগুলো বছর পুলিশের চাকরির জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে খালি পায়ে কীভাবে দিব্বি হেঁটে এলো এতটুকু অগ্নিদগ্ধ না হয়ে,ভাবতেই অবাক লাগে। আসুন,সবাই একবার দাঁড়িয়ে কামরুলকে তার নতুন জন্মদিনে, তার নতুন ইনিংসের সূচনাতে বুক টান করে একটা জবরদস্ত স্যালুট জানাই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে যেন সংসারের বৃহত্তর মাঠের ভিতর ব্যাটে, বলে ও ফিল্ডিংয়ে যোগ্য অধিনায়ক হয়ে সোনামুখ পরিবারকে সাফল্যের রৌদ্রকরোজ্জ্বল বন্দরে পৌঁছে দেয়।
চাকরিজীবন শেষে স্যার আমাকে বার বার বলতেন,
-তুমি পুলিশের চাকরি করলেও পুলিশ হতে পারনি। তাই তোমার জীবনের ব্যতিক্রমী ঘটনা নিয়ে একটা বই লেখো। ভবিষ্যতে পুলিশের চাকরিতে যারা ভাল কাজ করতে চাইবে তারা তোমার লেখা পড়ে ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। আমি তোমার পাশে থাকবো এবং বই প্রকাশের সকল দায় দায়িত্ব আমি নিজে নেবো।
আমি টুকটাক লেখালেখি করলেও বই লেখার মতো যোগ্যতা ও সাহস আমার কখনও ছিল না। তবুও স্যারের অনুপ্রেরণায় আমার পুলিশ জীবনের বিভিন্ন ব্যতিক্রমী ঘটনা নিয়ে একটি পর্ব দাঁড় করিয়ে স্যারের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। স্যার আমার লেখা পড়ে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে ফোন করলেন। আমার লেখার মান তেমন ভাল না হলেও তিনি বেশি বেশি প্রশংসা করে ভীষণ উৎসাহিত করলেন, যার ফলে আমার লেখার আগ্রহ শতগুণ বেড়ে গেল। তিনি বললেন,
– তোমার বই লিখতেই হবে। আমি দুই তিন দিনের মধ্যে তোমার বইটির নামকরণ করবো। যে কথা সেই কাজ। দুই দিনের ভিতর তিনি আমার বইয়ের নাম দিলেন,
‘একজন পুলিশের উজান বাওয়া’
স্যারের দেওয়া সেই নামের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি বই লিখছি। এ পর্যন্ত পঁচিশ পর্ব লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার বই শেষ না হতেই আমাকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে স্যার চলে গেলেন। আমার মাথার উপর চাপিয়ে রেখে গেলেন বইটি সমাপ্ত করার বিশাল বোঝা। স্যারের সম্মানে বইটি শেষ করা আমার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ালো। এখনো স্যারের আদেশ পালন করতে একটু একটু করে লিখে চলেছি। জানিনা, আমি বইটি কবে শেষ করবো বা সেটা আদৌ ছাপাখানার মুখ দেখবে কিনা।
সোনামুখ পরিবারের সেবামূলক কাজের সাথে অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ স্যার শুরু থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে মানসিক শক্তি সঞ্চার করতেন। ১৯৯২ সাল থেকে সোনামুখ পরিবারের সকল কার্যক্রমে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা। এই পরিবারের সকল সদস্য স্যারের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে সোনামুখ পরিবার, বিএল কলেজ রোড শাখার সকল সদস্য স্যারের বন্ধু বনে গিয়েছিল। স্যারের উদ্যোগে ‘সোনামুখ মানবিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ নামে একটি শাখা সংগঠন গঠন হলো। স্যারের নিরলস প্রচেষ্টায় ডুমুরিয়া উপজেলার আন্দুলিয়া গ্রামে পনেরটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে দুইদিন ব্যাপি বিশাল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। সেই সংগঠনের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ। তাঁর একক পরিচালনায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হলো সেই কঠিন প্রতিযোগিতা।
১৯৯৯ সালে আন্দুলিয়া গ্রামে সোনামুখ পরিবার আয়োজন করে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ধর্মের সমন্বয়ে এক ব্যতিক্রমী ও ঝুঁকিপূর্ণ ধর্মসভা। সেই ধর্মসভায় খুলনা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র জনাব শেখ তৈয়বুর রহমানের সভাপতিত্বে মুসলিম ধর্মের বক্তা ছিলেন অধ্যাপক রিজাউল করিম মন্টু, খ্রিস্টান ধর্মের বক্তা ছিলেন ফাদার মারিনো রিগন ও হিন্দু ধর্মের বক্তা ছিলেন অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ। সকল ধর্মের অসংখ্য নারী পূরুষের উপস্থিতিতে অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ হিন্দু ধর্মের কথা বলতে গিয়ে হিন্দু ধর্মের উপর সামান্য আলোকপাত করার পর ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় আরবি ও ইংরেজি ভাষায় এমনভাবে তুলে ধরেছিলেন যা শুনে সকল ধর্মের নারী পূরুষ একসাথে গলাগলি করে কাঁদতে শুরু করেছিল। গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ পিনপতন নীরবতায় স্যারের বক্তব্য শুনে ধর্মের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করেছিল। সেই বক্তব্যের রেশ ধরে পুনরায় স্যারের বক্তব্য শুনতে, কয়েক বছর পর একই গ্রামে আরো একবার একই অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল।
সোনামুখ পরিবারের যেকোন অনুষ্ঠানে স্যারকে আমন্ত্রণ জানানোর সাথে সাথে তিনি শত কাজ ফেলে, অনেক সময় অসুস্থ শরীর নিয়ে সঠিক সময়ে হাজির হতেন। এমনকি ঈদ-এ- মিলাদুন্নবী ও ইফতার মাহফিলেও তিনি প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করতেন।
সোনামুখ পরিবারের শিশুদের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ছোটদের সাথে পিকনিকে গিয়ে তিনি মজার ছলে অসাধারণ শিক্ষা দিতেন। শিশুদের সাথে মিশে শিশু সাজায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
আমরা দু’জন মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ঘুরতে গিয়ে নিজেদের মাঝে হারিয়ে যেতাম। কখনও প্রকৃতির মাঝে, কখনও কোন ঐতিহাসিক স্থানে স্যারের সাহচর্য ভুলবার নয়। দক্ষিণডিহির রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, সাগরদাঁড়ির মধুমেলা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্যারের ছোঁয়া আমার দেহমন জুড়ে আছে।
আমি যখন মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে চাকরিতে ছিলাম, তখন ঐ এলাকার শিক্ষার হার সকল জেলার তুলনায় কম দেখে আমার মন খারাপ হতো। আমার বন্ধু জনাব শাহে আলম শ্রীনগরে ‘সিজুঁয়ে কিন্ডারগার্টেন’ নামে একটি উন্নতমানের স্কুল করেছিলেন। সেই স্কুলসহ আশেপাশের কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মান দেখে আমার মন খারাপ হতো। তাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ঐ এলাকার শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে স্যারের সাথে পরামর্শ করলাম। স্যার এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। খুলনা থেকে বাসে করে তিনি পদ্মা নদীর ঘাটে গেলে আমি ও জনাব আলম গাড়িতে করে প্রথমে আমার বাসায় নিয়ে যেতে চাইলাম। ভাবলাম, তিনি বয়স্ক মানুষ। একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর ক্লাসে যাবেন। কিন্তু তিনি আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সরাসরি ক্লাসে গিয়ে হাজির হলেন। দুপুরে সামান্য খাবার খেয়ে আধাঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে সবার আগে ক্লাসে হাজির হলেন এবং বিকাল পর্যন্ত একটানা ক্লাস নিলেন। ঐ ক্লাসে অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষক ক্লান্ত হলেও স্যারের মধ্যে ঐ বয়সেও ক্লান্তির লেশমাত্র চিহ্ন দেখিনি। এভাবে পরপর দুই দিন প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষকের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখে আমার অহংকার শতগুণ বেড়ে গেল।
রাতে থাকার জন্য স্যারকে ডাকবাংলোর একটি পরিপাটি রুমে নেওয়ার পর তিনি বললেন,
-আমাকে এখানে কেন এনেছো?
-রাতে থাকার জন্য স্যার।
-তুমি কোথায় থাকো?
-আমার বাসা আছে স্যার। কিন্তু আমি ব্যাচেলর থাকি। রুম অনেকগুলো, কিন্তু মাত্র একটি খাট।
-তোমার খাটে একসাথে ঘুমালে তোমার খারাপ লাগবে? আমি তোমার সাথে এক খাটে থাকতে চাই।
আমি তাঁর কথায় অবাক হয়ে কিছু সময় নীরব থেকে, আমার বাসায় নিয়ে গেলাম। আমার খাটটি মোটামুটি বড় দেখে স্যার বললেন,
-আমাকে তোমার ছোঁয়া বঞ্চিত করলে আমার শ্রীনগর ভ্রমন ব্যর্থ হতো।
তারপর আমরা দু’জন গল্প ও কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রীতিমতো বন্ধু বনে গেলাম এবং শেষ পর্যন্ত স্যার আমাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন। লজ্জা আর অহংকারে আমার মনটা ভরে গেল।
জনাব শাহে আলমের আমন্ত্রণে তিনি আরো একবার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে শ্রীনগর গিয়েছিলেন। আমি তখন সেখানে চাকরি না করলেও স্যারের হুকুমে সেই প্রশিক্ষণে আমি হাজির হয়েছিলাম। স্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনে জনাব আলম বারবার চোখের পানি ফেলেছিলেন।
অরোতীর্থ বিদ্যাপীঠ ও অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ একই সূত্রে গাঁথা। এই তীর্থে তিনি ডুবে থাকতেন সারাক্ষণ। তাঁর অন্তিম যাত্রার দিন দীর্ঘ সময় তাঁকে সেখানেই রাখা হয়েছিল। এই বিদ্যাপীঠের নানা সমস্যায় তিনি আমাকে বার বার স্মরণ করতেন। আমিও মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে স্যারের সাহচর্যে নিজেকে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করতে চেষ্টা করতাম। স্যারের একক চিন্তায় গঠিত অরোট্রাস্টের কাজ অসমাপ্ত রেখে তিনি চলে গেলেন। ইতোমধ্যে তাঁর সুযোগ্য সন্তানেরা ও আমরা সকল ট্রাস্টি একত্রিত হয়ে স্যারের অন্তিম ইচ্ছে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হয়তো একদিন এই অরোট্রাস্ট মানব সেবায় অবদান রেখে অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ স্যারের ইচ্ছেপূরণে সচেষ্ট থাকবে।
শুরুতেই বলেছিলাম- স্যারের সাথে আমার স্মৃতি লিখতে গেলে কয়েকটি বই হয়ে যাবে। তাই স্মৃতির খাতা এখানে বন্ধ রেখে একটি গোপন কথা ফাঁস করতে চাই। তিনি চলে যাবার আগে আমাকে বলেছিলেন,
-আমি কিছুদিন তোমার সাথে থাকতে চাই।
আমি খুশি হয়ে বলতাম -আসুন স্যার, আজ থেকে শুরু করি।
তিনি আস্তে আস্তে বলতেন,
– আমার বাড়ির কাজ চলছে। এখন যদি আমি তোমার কাছে পালিয়ে যাই তাহলে সকলে মিলে আমার উপর ক্ষেপে যাবে। বাড়ির কাজ শেষ হলে আমি অবশ্যই তোমার সাথে থাকবো।
আমাদের সেই গোপন আশা আর কখনো পূরণ হবে না। কিন্তু আমার মনের ঘরে অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ স্যারের বিচরণ চিরকাল থাকবে। নক্ষত্রের আলো সৃষ্টির শেষ দিন পর্যন্ত যেমন আলো ছড়াবে, আমার ঘরেও তেমনি তিনি আলো হয়ে জ্বলজ্বল করবেন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)
খুলনা গেজেট/ বিএমএস