খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আইপিএল নিলামে অবিক্রিত মোস্তাফিজুর রহমান, ভিত্তিমূল্য ছিলো ২ কোটি রুপি
  ইসকন নেতা চিন্ময় দাসকে বিমান বন্দরে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি
  কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ দুই শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার
  সাবেক আইজিপি মামুনের ফের ৩ দিনের রিমান্ড

হিয়ার বাড়িতে এখনও নিস্তব্ধ আঁধার

বাপী দে

সন্ধ্যার আগেই যেন নিস্তব্ধ আঁধার নামে খুলনার বয়রা মধ্যপাড়ার ১৮ নম্বর ‘মিয়াবাড়ি’তে। পাড়া-প্রতিবেশীরা নীরবে আসছেন আর সিক্ত নয়নে বাড়ি ফিরছেন। এই বাড়িতে শিশু থেকে বেড়ে উঠেছে মোবাশ্বেরা তানজুম হিয়া। নানা গুণের মেয়েটি আর এ বাড়িতে ফিরবে না, কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। রুদ্রশ্বাস কষ্ট আর বেদনায় ওঠে আসছে ক্ষোভও। এ ক্ষোভ গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) বালুর মাঠের পাশে গভীর অরক্ষিত লেক নিয়ে। যে লেকে বান্ধবী তাসফিয়া জাহান ঋতুসহ জীবন দিয়েছেন হিয়া। দুজনই পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।


রুদ্রশ্বাস কষ্ট আর বেদনায় অরক্ষিক ‘লেক’ নিয়ে ক্ষোভ স্বজনদের


মঙ্গলবার (০১ আগস্ট) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৃষ্টিতে ভিজছিলেন দুই সহপাঠী মোবাশ্বেরা তানজুম হিয়া ও তাসফিয়া জাহান ঋতু। একটি লেকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যান সাঁতার না– জানা হিয়া। তাঁকে বাঁচাতে লেকের পানিতে ঝাঁপ দেন তাসফিয়া। কিন্তু দুজনের কেউ আর লেক থেকে উপরে ওঠতে পারেননি। সেখানেই পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যু হয়।

বুধবার (০২ আগস্ট) বিকেলে নিজ বাড়িতে মেয়ের নানা স্মৃতিচারণ হিয়ার বাবা মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘একটি মেয়ে ও একটি ছেলে নিয়ে আমরা পরিবারের চারজন সদস্য। আমাদের সঙ্গে ছেলে-মেয়ের বন্ধুর মতো সম্পর্ক। বাড়িতে অনেক রুম খালি পড়ে থাকলেও কেউ আলাদা থাকতে চায়না। আমি একটু অসুস্থ হলে মেয়েটি সারারাত মাথার কাছে বসে থাকতো। কখন কী দরকার নিজেই করে দিত। একটু দুরে রাখা যেত না। সেই মেয়েটি হারিয়ে গেল। হাজার হাজার স্মৃতি। ’

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। চেষ্টাও করেছে। এরমধ্যেই আমাকে বললো,‘ডাক্তার হতে পারিনি বলে তোমার কষ্ট! জিপিএ -৫ পেয়েছি। তাতেও হলো না। ভাগ্যে নেই। এবার চারের মধ্যে চার পাওয়ার পড়বো’। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।’
বিশ্ববিদ্যালয় লেকে ডুবে মেয়ের মৃত্যুতে চাপা কষ্ট প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের সন্তানরা অনেকেই সাঁতার জানেনা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিভাবে এমন একটি গভীর লেক অরক্ষিত রাখলো। কেন একটি বেষ্টনী দেওয়া হলো। আমি যা হারিয়েছি, আর ফিরে পাব না। কিন্তু এমন অরক্ষিত লেকে যেন আর কোন বাবার বুক খালি না হয়।’

নিজ কন্যাকে বাঁচাতে গিয়ে বান্ধবী ঋতুর মৃত্যুতে প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ওদের বন্ধুত্ব সেই স্কুল জীবন থেকে। কে কাউকে ছাড়া চলতো না। জেনেশুনে ‘বন্ধুর জন্য জীবন বিসর্জন’- এটি কয়জনের পক্ষে সম্ভব। ও (হিয়া) খুলনা থাকতে পছন্দ করতো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নিবাসের পাশেই একটি ভাড়া বাসায় দু’বান্ধবী থাকতো। পরীক্ষার পর দুজনের একই সাথে আসার ইচ্ছে ছিল। ওদের সেই ইচ্ছে আর পুরণ হলো না।’

হিয়ার বড় কাকা মো. মাসুদুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি গভীর লেক কিভাবে এমন অরক্ষিত রাখলো? একটি বেষ্টনী নেই, সতর্কতা সাইন বোর্ড নেই। ঢালু নীচে নামার সিঁড়ি নেই। এতো ‘মরণ ফাঁদ’। আমরা চাই না, এমন ফাঁদে আর কোন মা-বাবার বুক খালি হোক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষতো তাদের দায় এড়াতে পারবে না। আমরা আমাদের সন্তানদের আর পাব না। কিন্তু আর কারো যেন এমন না হয়।’

হিয়াদের প্রতিবেশী স্কুল শিক্ষক শিকদার ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘মেধাবী মেয়েটি মৃত্যু কোনভাবে আমরা মানতে পারছি না। সাঁতার না জানা বড় বিপদ হলো। এমন মৃত্যুর হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ জরুরী।

মোবাশ্বেরা তানজুমেরা দুই ভাই-বোন ছিলেন। তিনি ছিলেন বড়। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত। খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় (মন্নুজান স্কুল) থেকে এসএসসি ও খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। হিয়ার ছোট ভাই তাহমিদ আহমেদও খুলনা সিটি কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।বোনকে হারিয়ে স্বাভাবিক কথা বলতে পারছেন না ছোট ভাই তাহমিদ।

আদরের বড় সন্তান হিয়াকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মা সেলিনা বেগম।

এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হিয়ার মৃতদেহ নগরীর বড় বয়রা মধ্যপাড়া এলাকার বাড়িতে আনা হয়। মরদেহ আসার পর থেকে বাড়িতে শত শত মানুষের ভিড়। স্বজন, পাড়াপড়শিরা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বন্ধুরা সবাই শেষবারের মতো দেখতে আসেন। রাত ১১টার দিকে নগরীর গোয়ালখালি কবরখানায় দাদা-দাদির কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন হিয়া।

খুলনা গেজেট/কেডি




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!