দক্ষিণাঞ্চলে তিনি সিটি কলেজের আলী আহমেদ স্যার হিসেবে পরিচিত। এখানে শিক্ষকতা করেছেন ৩০ বছর। এর পাশাপাশি আরও দু’টি পরিচয় রয়েছে তাঁর। তিনি দীর্ঘ সময় পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। আবার জনগনের মুক্তির লক্ষে রাজনীতির মিছিলেও ছিলেন। তিনি বিদায় নিয়েছেন স্বাধীন দেশের খুলনার প্রথম সম্পাদক হিসেবে এ গর্ব নিয়ে। জন্মভুমির সাপ্তাহিক হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। স্বাধীন দেশে খুলনার প্রথম পত্রিকা জন্মভূমি। আর এর গর্বিত সম্পাদক অধ্যাপক আলী আহমেদ।
ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত খুলনার এম এম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। শত সহস্র শিক্ষার্থীর গর্বিত শিক্ষক। আর এ গর্ব নিয়েই তিনি দিনভর বেড়াতেন। দক্ষিণাঞ্চলের যে প্রান্তে-ই যেতেন সেখানেই তার স্নেহধন্য ছাত্রের সন্ধান পেতেন। অনেক খ্যাতিমান শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে বাবা ও সন্তান দু’জনেই এ গর্বিত শিক্ষকের ছাত্র।
কর্মজীবনের প্রথমদিকে মুসলিমলীগের দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। একটি নির্দিষ্ট আদর্শ লালন করলেও দলমত নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। স্নেহধন্য ছাত্র হুমায়ুন কবির বালু বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনে বিশ্বসী ছিলেন। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি তার রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা। ছাত্র হুমায়ুন কবির বালু বিপরীত দর্শনের মানুষ হলেও শিক্ষকের সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ছাত্রনেতা বালু শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক আলী আহমেদকে সাপ্তাহিক জন্মভূমির সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। স্নেহভাজন ছাত্রের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সাপ্তাহিক জন্মভূমির প্রথম প্রকাশ। সম্পাদকের ভাষ্য অনুযায়ী স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে জন্মভূমির প্রথম প্রকাশনার দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়। মূলত: ১৯৭০ সালে এ পত্রিকাটির প্রকাশনার অনুমতি পায়। আজকের মত কম্পিউটার, ইন্টারনেটের যুগ ছিল না। ৪৯ বছর পূর্বে পত্রিকা প্রকাশনা ছিল দুরূহ। লেটার প্রেসে ছাপা হত, ট্যাবলয়েড সাইজের পত্রিকা। প্রকাশনার দিনটি ছিল আনন্দের। সে আনন্দ সম্পাদক দীর্ঘদিন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন। পত্রিকার মূল্য ছিল ২০ পয়সা। ট্যাবলয়েড সাইজের পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে। মডার্ণ ফার্ণিচারের মোড়ে ছিল পত্রিকার বার্তা বিভাগ। বার্তা সম্পাদক হিসেবে ওয়াদুদুর রহমান পান্না দায়িত্ব পালন করতেন। তার অমর সৃষ্টি ‘জোহরা খাতুন শিশু বিদ্যা নিকেতন’। ১৯৮২ সালের ১৪ এপ্রিল হুমায়ুন কবির বালুর মালিকানা ও সম্পাদনায় জন্মভূমি দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এর আগে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জন্মভূমির উদ্ধোধনী সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘বীরের বেশে জাতির জনক নিজের দেশে ।’সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জীবদ্দশায় সাপ্তাহিক জন্মভূমির সম্পাদক আলী আহমেদ বলেন, উদ্ধোধনী সংখ্যায় চাহিদা ছিল বেশি। লিবার্টি প্রেসে উদ্ধোধনী সংখ্যা ছাপতে গিয়ে কয়েক ঘন্টা সময় লেগে যায়।
পত্রিকার সাংবাদিক কর্মচারিরা দিনরাত পরিশ্রম করে খুলনাবাসীর জন্য একটি সৃজনশীল পত্রিকা উপহার দেন। জন্মভুমির জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়তে থাকে। ১৯৭৪ সালে পূর্বাঞ্চল দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে অধ্যাপক আলী আহমেদ নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সাল থেকে দৈনিক অনির্বাণ সম্পাদনা করেন।
১৯৭২-১৯৭৮ খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন খুলনা প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু ত্রাণ তহবিলে ৫ শ’ টাকা দান করে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। পরবর্তীতে ৯১-৯২ সালে খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনও করেন। ১৯৮৮ ও ৮৯ সালে বাংলাদেশ এডিটরস কাউন্সিলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
গণমাধ্যম কর্মি অধ্যাপক আলী আহমেদের অন্যন্য সৃষ্টি খুলনার আহসানউল্লাহ ডিগ্রি কলেজ, খুলনা শিশু বিদ্যালয়, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় মুরারীকাটি ইউনাইটেড হাইস্কুল ও আশাশুনির শহীদ জিয়া কলেজ (অধুনালুপ্ত)। সৃজনশীল এ মানুষটি তার সৃষ্টির মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন।
খুলনা গেজেট/কেএম