খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

স্বাধীনতা সংগ্রামী মনি সিংহ

ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল

১৯০১ সালের ২৮ শে জুলাই স্বাধীনতা সংগ্রামী মনি সিংহ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন আর ১৯৯০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু দিন। । ১৯২১ সাল থেকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল তাতে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন, তবে এর আগে স্কুলে পড়তে পড়তেই তিনি অনুশীলন দলের সাথে পরিচিত হন ও তাদের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন ।

যদিও ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আদর্শের অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি পরবর্তী সময়ে অনুশীলন দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ত্যাগ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কে আদর্শরূপে গ্রহণ করেন। ১৯২৮ সাল থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন দেশের কাজে। ১৯৩০ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে পাঁচ বছর জেলে বন্দী করে রাখা হয় । জেল থেকে বেরিয়ে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করেন। আবার গ্রেফতার হন। ১৯৩৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পান মানুষের চাপে। ১৯৩৮ সালে ময়মনসিং জেলায় আরও কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেন।

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য জেল, জুলুম, নির্যাতন ভোগ করেই তার জীবনের বেশির ভাগ দিন কেটেছে পরাধীন ভারতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্থানের বিভিন্ন অংশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও সুশাসন মুক্ত সমাজের জন্য লড়াই করার অপরাধে তাঁকে জেলে বা আত্মগোপনে জীবন যাপন করতে বাধ্য হতে হয়ে ছিল বছরের পর বছর । তিনি আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ করতে থাকেন । ১৯৪৯ সালে পূর্ব বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি নির্বাচিত হন। পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ১৯৬৯ সালে। ১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থান এর চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে তিনিও জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। ২৫ শে মার্চ সামরিক আইন জারি হলে তিনি আবার গ্রেফতার হন জুলাই মাসে ।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হল, সেই সময় তিনি রাজশাহী জেলে বন্দী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দিরা রাজশাহী জেল ভেঙে তাকে মুক্ত করে। জেল থেকে বেড়িয়ে ভারতে চলে আসেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন সাহায্য আদায় করার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অপরিসীম । ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। সেই সময় তাকে আবার গ্রেফতার করে প্রায় ছয় মাস জেলে পাঠানো হয়। সুসং এ টংক প্রথার বিরুদ্ধে যে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় তিনি তার অবিসংবাদি নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। টংক আন্দোলনকে ঘিরে তাঁর সাহসী, বলিষ্ঠ ভূমিকা তাকে ঐ আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতৃত্বের মর্যাদায় উন্নীত করেছিল । টংক আন্দোলনকে তখন চূড়ান্ত দমন-পীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছে কিন্তু তাঁর লড়াকু মেজাজে পিছু হটতে হয়েছে শাসককে বারবার। চারদিকে শাসকের আস্ফালন চলছে ‘কমিউনিস্টের এবার কবর দিয়ে দিলাম’। এর প্রতিউত্তরে মণি সিংহ বলতেন “কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। এই পার্টিকে যারা ধ্বংস করতে চাইবে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। কমিউনিস্ট পার্টি জিন্দা আছে, জিন্দা থাকবে”।

পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট আন্দোলনের তিনি একজন কিংবদন্তী নেতা। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। বলা যায় ওদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি ছিলেন তিনি। আবার মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন মণি সিংহ । স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাদের সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য হিসেবে তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। একথা আজ স্বীকৃত যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশী বিদেশী শক্তির সমাবেশ, ঐক্য গড়ে তুলতে এবং বাঙালি জাতির মরণপণ সংগ্রামকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে তার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান অমূল্য।
তাঁর মধ্যে ছিল বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন। তিনি শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতেন । এছাড়াও জেলের বন্ধুদের প্রতি মমতা, সাধারন কয়েদিদের সাথে ভালো আচরণ এসব ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বন্দীদের আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাকে নিরন্তর লড়াই করতে দেখে অভ্যস্ত ছিল সহ-বন্দীরা। রেশন কেন খারাপ, পত্রিকা আসতে দেরি কেন, ডাক্তার রাউন্ডে থাকে না কেন – ইত্যাদি নানান প্রশ্নে জেরবার করে তুলে কারা কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতেন বন্দীদের যথাযথ মর্যাদা দিতে ।

জেলেই জীবনের প্রায় অর্ধেক কেটে যাওয়ায় আর বাইরে আন্দোলনের কাজে মাঠে-ঘাটে কেটে যাওয়ায় তাত্ত্বিক মার্কসবাদী হিসেবে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ যেমন তিনি পাননি এটা ঠিকই । তবে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে তিনি তত্ত্বের প্রয়োগ করতে পারতেন সহজাত দক্ষতার সাথে । শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন। পারিবারিক স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সশস্ত্র টঙ্ক আন্দোলন পরিচালনাতে ছিলেন। পাকিস্তান তৈরির পর গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। মাওবাদীদের বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। দক্ষিণপন্থী পদস্খলনের বিপদ সম্পর্কে সব সময় সতর্ক রাখতেন নিজেকে ও দলের সকলকে । গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নিয়মিত অনুশীলন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। নীতি-আদর্শের বিচ্যুতি তাঁর ছিল না । তিনি কখনো সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিতেন না। সততা, ত্যাগ, আদর্শনিষ্ঠা, বিপ্লবী আত্মসচেতনতা, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ, দায়িত্ববোধ – এইসব দৃষ্টান্তস্থানীয় অসামান্য গুণের সমাবেশ ছিল তার মধ্যে ।

লেখক পরিচিতিঃ সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!