পূর্ব প্রকাশের পর)
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত বিশ্ববাসীর কাছে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। যাদের মধ্যে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এবং আহমেদ ছফার মত ব্যক্তিদের কথা না বললেই নয় আবার কবিদের মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, বন্দে আলী মিয়া, নির্মলেন্দু গুণের মত প্রমুখ কবিদের নাম কারোর অজানা নয়। যাইহোক, বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত আদমশুমারির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এই হিসাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৮ম জনবহুল দেশ। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ২০০৫ সালে ছিল প্রায় ৪১ শতাংশ। ২০১৬ তে তা আরও বৃদ্ধি লাভ করে ৭২.৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৯ শতাংশ। ২০০৭ এর তুলনায় সাক্ষরতার হার ২৬.১০ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য ২০১০ সাল থেকে সরকার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে আসছে। শিক্ষা বছরের প্রথম দিনের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন ক্লাসের বই তুলে দেয়ার ঐতিহ্য প্রবর্তিত হয়েছে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে। যদিও, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়। তবে এখন বাংলাদেশে ৩৭টি সরকারি, ৮৩টি বেসরকারি এবং দুটো আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাস্থ ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। জন্মকালে শিশু মৃত্যুহার ছিল ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, হাজারে ৫৩ জন ও মাতৃমৃত্যুর হার হাজারে ১৪৩ জন, যা কিনা ২০২০ সালে এসে ২৪ জন এবং ৩ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন পোলিও মুক্ত দেশ।
ধর্মীয় স্বাধীনতা বাংলাদেশিদের একটি সাংবিধানিক অধিকার, তবুও কিছু বিছিন্ন ঘটনা আমাদের হৃদয়কে ব্যাথিত করে। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষ বেশকিছু সার্বজনীন উৎসব পালন করে যার মধ্যে পহেলা বৈশাখ অন্যতম। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে নবান্ন, পৌষ-পার্বণ ইত্যাদি লোকজ উৎসবের প্রচলনও রয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে শহিদ দিবস ঘটা করে পালিত হয়। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে গ্রন্থ মেলা তরুণ ও শিক্ষিত সামাজে এবং লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে বয়ে আনে নতুন আমেজ।
শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলার অঙ্গনেও বাংলাদেশ অতীতের তুলনায় অনেক এগিয়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এ যাবৎ ৫জন বাংলাদেশী নিয়াজ মোর্শেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব এবং এনামুল হোসেন রাজীব দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব লাভ করেছেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে, যার ফলে ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো তারা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। সেবছর প্রথম পর্বে বাংলাদেশ স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে পরাজিত করে। এছাড়া ২০০০ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট ক্রিকেট খেলার মর্যাদা লাভ করে। বাংলাদেশের খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সব ফরম্যাট ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মর্যাদা অর্জন করেন। বাংলাদেশ ২০১১ সালে যৌথভাবে ভারত ও শ্রীলঙ্কার সাথে আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ এককভাবে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের খেলোয়াড়রা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় মহিলা এশিয়া কাপ জয় করার মাধ্যমে।
উন্নত বাংলাদেশ গড়তে করণীয়
স্বাধীনতা অর্জন হতে রক্ষা করা কঠিন’ এ বাক্যটি আমাদের অজানা নয়। ঠিক উন্নয়নের স্থিতিশীলতা রক্ষা করাটাও অনেক কঠিন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, ৭১ এর ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এ দেশ বিশ্ববাসীর কাছে আজ উন্নয়নের এক রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু উন্নত দেশ হিসাবে নিজেকে পরিচিত করতে এখনও দেশ ও দেশের জনগনকে অনেক বিষয়ের উপর মনোযোগী হতে হবে। দেশের সার্বিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি তার মধ্যে অন্যতম যা সম্ভব দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, দক্ষ ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনার, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির ব্যবহার এবং মানসম্পন্ন কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে। এগুলোর পাশাপাশি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন রোধ করা। ‘ব্রেইন ড্রেন’ একটি দেশের উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ করে। কারণ,একটি দেশ থেকে বুদ্ধিজীবী এবং দক্ষ শ্রমিকরা চলে যাওয়ার সাথে সাথে মেধার শূন্যতা দেখা দেয় যার ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যহত হয়। বাংলাদেশের জন্য মেধা পাচার কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা বোঝা যায় একটি জরিপ থেকে। জরিপটিতে দেখা গিয়েছে শুধু ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ মিলিয়নেরও বেশি লোক দেশত্যাগ করেছে। এছাড়াও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অপর এক জরিপে ১৫-২৯ বছর বয়সী প্রায় ৮২% তরুণ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। যা আমাদের দেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়তে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ বিশ্বের অপর সম্ভাবনার এক দেশ, যার কাছে আছে তরুণ শক্তির এক বিশাল ভাণ্ডার, আছে ভূ-রাজনৈতিক উৎকৃষ্ট মানের অবস্থান। এ দেশ এখন বৈদেশিক বিনিয়োগের এক উর্বর ভূমি। এখন প্রয়োজন নতুন নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণার অগ্রগতির মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
শেষকথা
বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি। এই অর্থনীতির বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে মধ্যমহারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, পরিব্যাপ্ত দারিদ্র্য, আয় বণ্টনে অসমতা, উল্লেখযোগ্য বেকারত্ব, জ্বালানী, খাদ্যশস্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য আমদানী নির্ভরতা, জাতীয় সঞ্চয়ের নিম্নহার, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমহ্রাসমান নির্ভরতা এবং কৃষি খাতের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু পলিপ্রোপিলিন পণ্যের আগমনের ফলে ১৯৭০ সালের থেকেই পাটজাত দ্রব্যের জনপ্রিয়তা ও বাণিজ্য কমতে থাকে, যা তৈরি পোশাক শিল্প আবার ফিরিয়ে আনে।
পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। আবার, সদ্য শেষ হওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় উনিশ হাজার কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা। পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে কৃষি উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬ এবং ৬ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আগ্রগতির এক বড় উদাহরণ। একই সময়, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্সীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক এ দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করেছে। এই উন্নয়নের ধারা বাহিকতার সাক্ষী হতে যাচ্ছে, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর রাজশ্রী এস পারালকার এবং এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ। পরিশেষে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে যা দেখে এটাও বলা যায়, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
(লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/কেএম