ঘূর্ণিঝড় মোখা মূল আঘাত হেনেছে মিয়ানমারে। এর কেন্দ্রের একটি অংশ বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে গেছে। তবে সাগর থেকে মাটিতে এসে মোখা অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। এ কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
মোখা দুর্বল হওয়া এবং বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় তুলে ধরেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদেরা।
প্রথমত, ঘূর্ণিঝড় গতিপথের বাঁ দিকের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনের ওপর দিয়ে গেছে মোখার কেন্দ্রের বাঁ দিক। দ্বিতীয়ত, সেন্ট মার্টিনে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে মোখার কেন্দ্র অতিক্রম করে। তখন ছিল ভাটার সময়। এতে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা কমে যায়। তৃতীয়ত, ভারী বৃষ্টি যেহেতু হয়নি, তাই পাহাড়ে ভূমিধস হয়নি।
মোখা কীভাবে দুর্বল হয়ে গেল, তার ব্যাখ্যা জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, সাগরে অবস্থানকালে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রে বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠেছিল। এটির অগ্রভাগ শনিবার রাতে স্থলভাগে উঠে যায়। তখন ঘূর্ণিঝড়টির ‘বডির’ (মোট আয়তন) ৫০ শতাংশের সঙ্গে ভূমির মিথস্ক্রিয়া হচ্ছিল। আর পাহাড় ও গাছপালার কারণে শক্তি কমছিল।
আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় যখন সাগরে থাকে, তখন জলীয় বাষ্প গ্রাস করে শক্তি অর্জন করে। ভূমিতে উঠে আসার পর আর ঘূর্ণিঝড় শক্তি অর্জন করতে পারে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল রোববার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর সেন্ট মার্টিনে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছে ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার, সেটা বেলা ২টা ২০ মিনিটে। দেশের অন্য উপকূল এলাকায় বাতাসের গতি ছিল এর চেয়ে অনেক কম। যেমন টেকনাফে ছিল সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ২ হাজার ২২, যেগুলো ঝুপড়ি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ হাজার ৪৬৯টি ঘরবাড়ি। এতে ঝড়ে কারও মৃত্যু হয়নি। নিখোঁজও নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও বাসিন্দাদের প্রাথমিক তথ্য হলো, বিভিন্ন জায়গায় গাছ উপড়ে গেছে, ডালপালা ভেঙে পড়েছে। সেন্ট মার্টিনে ১০ থেকে ১৫ জন আহত হওয়ার খবর জানিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। স্থানীয় লোকজন জানান, এক নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়লে তিনি মারাত্মক আহত হন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে গতকাল রাত পৌনে আটটায় জানান শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা। কার্যালয় সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা শিবিরে ২ হাজার ৫৪৮টি ঘর বিধ্বস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭ রোহিঙ্গা। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩২টি শিক্ষাকেন্দ্র (লার্নিং সেন্টার), ২৯টি মসজিদ ও মক্তব এবং ২০টি নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মিয়ানমারের আবহাওয়া বিভাগের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে এক প্রতিবেদনে জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোখা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আঘাত করে। এতে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর তথ্যকেন্দ্রের বরাত দিয়ে এপি আরও জানিয়েছে, রাখাইনে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের টাওয়ার ভেঙে গেছে এবং কোনো কোনো এলাকা জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ডুবে গেছে।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রামানাথন বালাকৃষ্ণ রয়টার্সকে বলেছেন, রাখাইনে আগে থেকেই মানবেতর অবস্থা বিরাজ করছিল, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তিনি বলেন, দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে হাজার হাজার মানুষের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারাই আবার ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিতে পড়েছে।
খুলনা গেজেট/এইচ