টানটান উত্তেজনা চলছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে। নেতাদের মুখেও রণগর্জন। সর্বাত্মক যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ‘রণমূর্তি’তে দুই দেশের সামরিক বাহিনীও। সীমান্ত চৌকিগুলোতে যুদ্ধাস্ত্রের ডামাডোল। ক্যান্টনমেন্টগুলো থেকে বহরে বহরে সেনা আসছে সীমান্তে। ভয়ংকর এক যুদ্ধাতঙ্ক দুদেশের সীমান্ত জনপদে। উদ্বেগ-উত্তেজনা-শঙ্কায় থমথমে পরিবেশ। দিনে সেনা টহল, রাতে হামলার ভয়। পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর এই যুদ্ধ দামামা ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্বেও। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে ‘বড় যুদ্ধ’র সম্ভাবনাও। এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে ভারত-পাকিস্তান গোলাগুলিতে কেঁপে ওঠে কাশ্মীর সীমান্ত। প্রায় রাতভরই চলে এ হামলা । নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) কয়েকটি অংশের বিচ্ছিন্ন এ গোলাগুলিতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এএফপি, বিবিসি, দ্য হিন্দু, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীই আগে গুলি চালায়। পালটা গুলি চালায় ভারতও। ভারতীয় সামরিক সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর কিছু ভারতীয় চৌকিতে গুলি চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে পিটিআই জানিয়েছে, ‘পাকিস্তানের উদ্যোগে নিয়ন্ত্রণরেখার কয়েকটি জায়গায় ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে।’ ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীও পালটা গুলি চালিয়েছে। থেমে থেমেই চলে।
তবে এ গুলিবিনিময়ে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। উত্তেজনার রেশ বাড়তে থাকায় পাকিস্তানে যে কোনো সময় হামলা করতে পারে ভারত। সে কারণেই হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। সীমান্ত লাগোয়া ঘাঁটিগুলোতে সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। পাকিস্তানের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলজাজিরাকে বলেছেন, আমরা উচ্চস্তরের সতর্কতা বজায় রাখছি। কিন্তু ভারতের মতো আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলে কোনো অপ্রয়োজনীয় হাইপ তৈরি করতে চাই না।
মঙ্গলবার বিকালে কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বৈসরণ উপত্যকায় হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগও দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। শুক্রবার পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে এ বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এতে ভারতের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জানানো হয়।
এছাড়া এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের যে কোনো পদক্ষেপের চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। সিনেট অধিবেশনে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, ভারত কোনো প্রমাণ ছাড়াই ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এগুলো ভারতের ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য। এসময় অতীতের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে ভারতকে সতর্ক করেন ইসহাক দার। বলেন, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’। যে কোনো শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত জবাব দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করা যাবে না, কারণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই চুক্তি স্থগিত করতে হবে। পানি ২৪ কোটি পাকিস্তানির জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি এরই মধ্যে পানি স্থগিতের হুমকিকে যুদ্ধের শামিল বলে ঘোষণা করেছে।’ কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলাকে ভারতেরই সাজানো নাটক (ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন) বলে মন্তব্য করছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটি বলেছেন তিনি।
শুক্রবার জিও টিভির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। সাক্ষাৎকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জম্মু ও কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে। তিনি এও বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে পূর্ণমাত্রার সংঘাতের আশঙ্কা নিয়ে বিশ্বকে ‘চিন্তিত’ হওয়া উচিত। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ‘যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত’ উল্লেখ করে খাজা আসিফ বলেন, ভারত যা-ই শুরু করুক না কেন, আমরা তার জবাব দেব। যদি কোনো সর্বাত্মক আক্রমণ বা এমন কিছু হয়, তাহলে অবশ্যই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে। তবে আলোচনার মাধ্যমে এখনো পরিস্থিতির সমাধান করা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। চলমান এ যুদ্ধাগুণে এদিন আবারও একদফা ঘি ঢালল ভারত।
এদিকে হামলার কারণ হিসাবে নিরাপত্তাব্যবস্থায় ত্রুটির দায় স্বীকার করেছে ভারত। বৃহস্পতিবার রুদ্ধদ্বার সর্বদলীয় বৈঠকে ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের তোপের মুখে পড়ে নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, প্রশাসনকে না জানিয়ে স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা ওই রুট খুলে দিয়েছিল। আর সন্ত্রাসীরা সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে। সরকার আরও জানিয়েছে, প্রতিবছর জুনে অমরনাথ যাত্রার আগে পহেলগাঁওয়ের রুট পর্যটকদের জন্য খোলা হয়। কিন্তু এবার স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা ২০ এপ্রিল থেকেই সরকারের অজান্তে তা খুলে দেয়। ফলে প্রশাসন নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের সুযোগ পায়নি। সরকারের এমন যুক্তিকে ভুয়া বলে দাবি করেছে বিরোধীরা। উত্তেজনার মধ্যেই শুক্রবার ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী শ্রীনগর ও উধমপুর সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে তিনি কাশ্মীর উপত্যকায় মোতায়েন ঊর্ধ্বতন সেনা কমান্ডার এবং নিরাপত্তা সংস্থার অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন।
দুই দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ভারতে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত রুভেন আজার। জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে হামাসের যোগ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া এ হামলার প্রেক্ষিতে কোনো যুদ্ধ হলে ইসরাইল ভারতের পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিবৃতি দেয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এই হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে সৃষ্ট উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কোনো ভূমিকা পালন করবে কিনা সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর।
খুলনা গেজেট/এইচ