খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ঘন কুয়াশায় শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

সারদার ট্রেনিং শেষে জেলায় যোগদান

এ এম কামরুল ইসলাম

ভাঙলো মিলনমেলা। সারদার হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝেও এক ধরনের সুখ ছিল। আমরা ৮৮ জন ক্যাডেট একসাথে এক বছর থেকে-খেয়ে একটা পরিবারের মত হয়ে গিয়েছিলাম। বন্ধু কাকে বলে, কত প্রকার, কি কি তা উদাহরণ সহকারে বুঝে গিয়েছিলাম। আমাদের ৮৮ জন ক্যাডেটের মধ্যে সেই বন্ধুত্ব আজ পর্যন্ত অটুট আছে। আবার কেউ কেউ আমাদের কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেছে।

এখানে একটা ঘটনা তুলে ধরলে সারদার বন্ধুত্বের গভীরতা কিছুটা বুঝা যাবে।

আমি, মানোয়ার ও আজাদ খুবই ঘনিষ্ট ছিলাম। একদিন এক দুর্ঘটনায় তিন জনের মনোমালিন্য হলো। সেই কারণে তিন জনের মধ্যে তিন দিন কথা বন্ধ থাকলো। সেই তিনটা দিন আমাদের তিন জনের কাছেই দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। জীবনের উপর ঘৃণা জন্মাতে শুরু করলো। মনে হতে লাগলো জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু জেদের বশবর্তী হয়ে পাশাপাশি থেকেও কেউ কারো সাথে কথা বলাবলি হতো না।

এমন পরিস্থিতিতে এক সন্ধ্যায় বাথরুমের কাছে গিয়ে তিন জনের দেখা হয়ে গেল। তিন জনের অজান্তেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল৷ কেউ একটি কথাও বলতে পারলাম না। তারপর থেকে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। ঠিক, শিশুকালের মত অবস্থা। এই ছিল সারদার জীবন।

এমন সুন্দর অথচ কষ্টের জীবন শেষ করে আমাদের ৮৮ জন ক্যাডেটকে বাংলাদেশের তৎকালীন ২২ টি জেলায় ভাগ করে পোস্টিং দেয়া হলো। আমরা পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হবার কষ্টে ও সারদার জীবনের পরিসমাপ্তির আনন্দে যার যার পোস্টিংপ্রাপ্ত জেলায় যোগদানের উদ্দেশ্যে পনের দিনের ছুটি ভোগ করতে বাড়িতে রওয়ানা হলাম।

মানোয়ার, হাবিব, মোতালেব, নাঈম, ইউসুপ এবং আমার পোস্টিং হলো গ্রেটার বরিশাল জেলায়। পনের দিন ছুটি ভোগ করার পর বরিশাল জেলায় যোগদান করলাম। আমি, হাবিব ও মোতালেবকে বরিশালে রেখে মানোয়ারকে ঝালকাঠি, নাঈমকে পিরোজপুর ও ইউসুফকে ভোলা জেলায় পাঠিয়ে দিলো। আবারও বন্ধুদের হারানোর ব্যথা আমাকে পেয়ে বসলো। বিশেষ করে মানোয়ারকে ঝালকাঠি জেলার জন্য বিদায় দিতে গিয়ে আমার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল। তারপরও বুকের জ্বালা বুকে ধারণ করে আমি বরিশালে রয়ে গেলাম। মানোয়ার চলে গেল ঝালকাঠি জেলায়।

চাকরি শুরু হয়ে গেল। আমাদের থাকার জায়গা হলো বরিশাল পুলিশ ক্লাবে। সন্ধ্যায় পুলিশ ক্লাবে বসে গল্প করছি। ভাবছিলাম শীতের রাতে বরিশাল শহর ঘুরে দেখবো। এমন সময় পুলিশ লাইন থেকে খবর এলো রাত দশটায় পুরা পোশাক পরে সকল অফিসারকে পুলিশ লাইনে হাজির থাকার জন্য এসপি সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন। সদ্য পুলিশের চাকরীতে যোগদান করা আমরা তিনজন পিএসআই অর্থাৎ শিক্ষানবিশ সাব ইন্সপেক্টর চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। এতদিন ধারণা ছিল সারদার কষ্টের জীবন শেষ করে জেলায় গিয়ে বড় দারোগা হয়ে আরামে দিন কাটাবো। মানুষের উপর খবরদারি করে জীবন পার করবো। কিন্তু চাকরির প্রথম দিনে একি শুনলাম!

যাহোক, এসপি সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী রাত দশটার আগেই পুরা শীতের পোশাকে পুলিশ লাইনে হাজির হলাম। সেখানে গিয়ে রীতিমতো অবাক হলাম। আরআই সাহেবের হাকডাক আর তর্জন গর্জন শুনে ভয়ে শরীর আড়ষ্ট হতে লাগলো। জেলার সকল অফিসার ও ফোর্স সেখানে হাজির ছিল। সকলকে পদ অনুযায়ী ‘ফল-ইন’ করা হলো। সবার শেষে এলেন এসপি মহোদয়। জনাব সরোয়ার হোসেন৷ চেহারা ও কথা বলার ভঙ্গি দেখে শ্রদ্ধা জাগে। তিনি হ্যান্ড মাইকে আস্তে আস্তে নম্রস্বরে কথা বললেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জনাব সৈয়দ বজলুল করিম মহোদয় আগে থেকেই সকল অফিসার ও ফোর্স ভাগ করে রেখেছিলেন৷ আমাকে রেখেছিলেন তাঁর নিজের ভাগে।

কী কাজে এত রাতে সকল অফিসার ও ফোর্স পুলিশ লাইনে আনা হয়েছিল তার আগামাথা কিছুই আমরা জানতাম না। এসপি সাহেবের নির্দেশে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে অফিসার ও ফোর্স অপেক্ষমান গাড়িতে উঠানো হলো। আমাকে এডিশনাল এসপি সাহেব তাঁর নিজের গাড়িতে উঠালেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গিয়ে গভীর রাতে এক গ্রামে চুপি চুপি নামবার নির্দেশ হলো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে ফিস ফিস আওয়াজে টিম লিডারের নির্দেশ মোতাবেক কাজ শুরু করলাম। গাড়ি থেকে নামার পর সেখানে কয়েকজন বোরখা পরা পুরুষ মানুষ উর্ধ্বতন অফিসারদের কানে কানে কথা বলেছিল। আমি এসব দেখে কিছুই ঠাহর করতো পারিনি। শুরু হলো বাড়ি বাড়ি তল্লাশী অভিযান। বোরখা পরা মানুষগুলি বাড়িঘর দেখিয়ে দেবার পর সেই বাড়িঘর তল্লাশী শুরু করা হতে লাগলো। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নির্ধারিত অফিসারের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আবার অন্য বাড়িতে তল্লাশী চলতে থাকলো। প্রতিটা বাড়িতে তল্লাশীর সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহোদয় আমাকে ঘরে ঢুকতে বলছিলেন। আমি বেশি বেশি উৎসাহিত হয়ে কাজ করছিলাম। হঠাৎ একজন আরআই সাহেব আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, “বাবা এটা বরিশাল। নতুন চাকরিতে এসেছেন। এখনও সবকিছু বুঝেন না। সাবধানে ঘরে ঢুকবেন। বরিশালের মানুষ কিন্তু পুলিশকে কোপায়। এখানে মহিলারাও ভীষণ ভয়ংকর। রামদা দিয়ে কোপ মারে।”

তিনি আমাকে ভাল জেনেই কথাগুলো বললেন।

আমি একটু ভয় পেয়ে সাবধান হলাম। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। বোরখা পরা একজন লোক একটি বাড়ি দেখিয়ে সেটা তল্লাশী করতে বললো। আমি ফোর্সসহ ঢুকে পড়লাম৷ ঘরে ঢুকে একজন আধা বয়সী মহিলাকে মেঝেতে মাদুরের উপর বসা দেখে তাকে উঠে দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু তিনি ঘুরে ফিরে একজায়গায় লেপ গায়ে দিয়ে বসে থাকেন। কোন প্রকারে তিনি ঐ জায়গা ছাড়ছিলেন না। আমার সন্দেহ হতে লাগলো। এক প্রকার জোর করে তাকে ঐ জায়গা থেকে উঠানো হলো। মেঝেতে বিছানো মাদুর তুলে দেখি মাদুরের নিচে বিশাল দুটি রামদা। চলতি অভিযানে ওটাই ছিল প্রথম উদ্ধার। আমি একটু জোর গলায় ঘটনা জানান দেওয়ায় বাইরে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহোদয় ঘরে ঢুকে রামদা দেখে আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “সাব্বাশ পিএসআই।”

আমিও অনেক খুশি হলাম।

সকাল হয়ে গেল। এই অপারেশনে যোগদান করা সকল অফিসার ও ফোর্স একটা স্কুলের মাঠে একত্রিত হলো। গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজনদের ও উদ্ধারকৃত অস্ত্রপাতির তালিকা করা হচ্ছিল। এতবড় অভিযানে উদ্ধারের তালিকায় শুধুমাত্র আমার সেই দু’খানি রামদা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সকালের আলোয় বুঝলাম এলাকাটা ছিল উজিরপুর থানার সর্বহারা কবলিত সন্ত্রাসী এলাকা। তাদের ধরার জন্য এই বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছিল।

ঐদিন বিকালে বিশেষ অভিযানের ফলাফল জানতে ও অংশগ্রহণকারী অফিসার ফোর্সদের ধন্যবাদ দিতে আবার পুলিশ লাইনে হাজির করা হলো। এসপি সাহেব যথারীতি হাজির হলেন। আরআই সাহেবের নিয়মিত হাঁকডাকের পর এসপি সাহেব ধন্যবাদ দেবার একফাঁকে এডিশনাল এসপি সৈয়দ বজলুল করিম সাহেব বললেন,“গতরাতের অভিযানে পিএসআই কামরুল ইসলাম অনেক দক্ষতা দেখিয়েছে। তাকে পুরস্কার দেবার সুপারিশ করছি।”

সাথে সাথে এসপি মহোদয় আমাকে দেখতে চাইলেন এবং আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে পাঁচ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। আমারও উৎসাহ বেড়ে গেল। পরদিনই আমাকে বরিশাল কোতোয়ালি থানায় ছয় মাসের শিক্ষানবীশ হিসেবে পোস্টিং দেয়া হলো। হাবিবকে মেহেন্দীগন্জ ও মোতালেবকে গৌরনদী থানায় পোস্টিং দিলেন।

পোস্টিং দেবার সময় আমাদের ফাইল ‘পুট-আপ’ করেন রিজার্ভ অফিসার সাহেব। তখন রিজার্ভ অফিসার ছিলেন জনাব মোশাররফ হোসেন সাহেব। এই মানুষটিকে দেখলে শ্রদ্ধা ভক্তিতে মাথা নত হয়ে যায়। পিতৃসুলভ এই মানুষটিকে আমার আজও মনে পড়ে। বরিশালে চাকরি করাকালীন তিনি আমাকে রীতিমত পিতৃস্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন।

আনন্দ

বরিশাল জেলায় তখন প্রায় সকল থানায় নৌপথে যাতায়াত করতে হতো। তাই ঐ জেলায় চাকরি করতে গিয়ে সকলেই কোতোয়ালি থানা পছন্দ করতো। আমরা তিনজন পিএসআই একই কারণে কোতোয়ালি থানায় পোস্টিং আশা করেছিলাম। তবে আমি কোন তদ্বির করিনি। অন্য দু’জন করেছিল কিনা তা আমি জানিনা। কিন্তু বিনা তদ্বিরে আমি আশাতীত ফল পেয়ে মহা খুশি হয়েছিলাম। আহা কী যে আনন্দ!

বেদনা

আমার দুই বন্ধু ব্যথাহত হয়ে দূরে চলে যাবার সময় পুলিশ ক্লাবে আমি একা হয়ে গেলাম। অবশ্য দুই বন্ধুর দূরে পোস্টিং হওয়ায় আমি তাদের কাছে এক প্রকার ঈর্ষার পাত্র হলাম। সেই ঈর্শার ফল পরবর্তী জীবনে আমাকে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে হয়েছিল। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!