খুলনার তেরখাদা উপজেলার আজগড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক রেজা মাহমুদের পরিকল্পনায় খুলনার খাদ্য পরিদর্শক সুশান্ত কুমার মজুমদার অপহৃত হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপহরণের সময় ভুক্তভোগীর গোঙানি ও চিৎকারের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। ওই রাতেই অপহৃতকে উদ্ধার এবং দুই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
অভিযোগ উঠেছে, অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রধান আসামিকে আড়াল করতে রূপসা উপজেলার সেনেরবাজার এলাকার নিরীহ দুই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এজাহারে ওই দুই ব্যবসায়ীকে আসামি করতে পুলিশ অপহৃতের স্ত্রীকে প্ররোচিত করেন। পরদিন গ্রেপ্তারের তথ্য পুলিশের পক্ষ থেকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। এতে বিভ্রান্ত হয়ে অনেক গণমাধ্যমে নিরীহ দুই ব্যবসায়ীকে অপহরণকারী হিসেবে সংবাদ প্রচার হয়েছে। এতে পরিকল্পনাকারী ও অপহরণ চক্রের পুরো টিমই আড়ালে চলে গেছে। ঘটনার দুই দিন অতিবাহিত হলেও মূল চক্রের কেউ এখনও গ্রেপ্তার হয়নি।
মঙ্গলবার রূপসা সেনের বাজার ঘুরে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিবার ও বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তেরখাদা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতারা রেজার রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। তবে ঘটনা আড়ালের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
গত রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরীর ৪নং ঘাট এলাকা থেকে সুশান্ত কুমার মজুমদারকে অপহরণ করে কয়েকজন ব্যক্তি। সাড়ে ৫ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে খুলনার তেরখাদা উপজেলার আজগড়া বিআরবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় সুশান্তকে উদ্ধার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় ওই রাতে রূপসার সেনের বাজারের ব্যবসায়ী আলমগীর কবির ও মুসা খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
চিকিৎসাধীন সুশান্ত কুমার মজুমদার জানান, রেজা নামের ব্যক্তি কয়েকদিন ধরে তার কাছে টাকা দাবি করছিলেন। অপহরণের পর প্রথমে তার কাছে ১৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। অপহরণকারীরা তাকে বেদম মারপিট করলে তিনি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন। এর মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। পরে পুলিশের তৎপরতায় তাকে ফেলে পালিয়ে যায় অপহরণকারীরা।

যেভাবে দুই ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার
মঙ্গলবার রূপসা উপজেলার সেনের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ঘাটের পাশে আলমগীর কবিরের মালিকানাধীন ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, সজ্জন ও নামাজী মানুষ হিসেবে আলমগীরকে সবাই চেনেন। তার মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট দোকানটি কৃষ্ণ নামের এক কর্মচারী চালায়। আলমগীরকে আটকের পর কৃষ্ণ ভয়ে দোকান খুলছে না।
বাজারের রাজ ফিশিং হাউজের কর্মচারী রাফিদুল আলম রুবেল বলেন, ‘ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে আলমগীর ভাই প্রায় আমাদের দোকানে আড্ডা দেন। রোববার রাত ১০টার দিকে দোকানে এসে বলেন, তার এজেন্ট নম্বরে ২৫ হাজার টাকা এসেছে। টাকা নিতে আসলে তাকে ধরতে সাদা পোশাকে পুলিশ বসে আসে। তিনিও পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বসেছিলেন। পুলিশকে সব ধরনের সহযোগিতা করেন। পরে শুনি তাকে নিয়ে গেছে।’
একই বাজারে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের দোকান ছিল মুসা খানের। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পরিশোধের জন্য তার নম্বর দিয়েছিল অপহরণকারীরা। রাতে তাকেও বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।

সেনের বাজারের পাশেই আলমগীর কবিরের বাড়ি। স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আলমগীরের একমাত্র মেয়ে রিদুয়ানার বাবার জন্য মন খারাপ করে বসে আসে। পরিবারটি কিভাবে চলবে, কে মেয়েটিকে দেখবে ভেবে হতাশা প্রকাশ করছেন প্রতিবেশীরাও।
সেনের বাজার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মোল্লা জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আলমগীর ও মুসা দু’জনেই খুব ভালো মানুষ। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের ব্যবসায় বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা আসে। এটা বোঝার উপায় নেই কিসের টাকা। নিরীহ দুই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারে বাজারের সবাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ।’
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সদর থানা এস আই সাইদুর রহমান দাবি করেন, অপহরণের টাকা আলমগীরের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে। মুসা খানের নম্বরে টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে, এজন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এজেন্ট নম্বরে অপহরণের টাকা আসলেই বা নম্বর দিলেই তারা অপরাধী হবেন এবং গ্রেপ্তার করতে হবে-এটা আইনসম্মত নয়। এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে।’
পরিকল্পনাকারী ছাত্রদলের সাবেক নেতা
সুশান্ত কুমার মজুমদারকে তুলে নেওয়ার পরপরই তার স্ত্রী থানায় অভিযোগ করেন। সেখানে রেজা নামের এক ব্যক্তির মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়। ওই নম্বরে ফোন করলে মোবাইল অ্যাপে যুবদলের এক নেতার সঙ্গে রেজার ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু সোমবার রাতে যুবদল নেতারা রেজাকে চেনে না বলে জানায়।
রাতে সুশান্তের স্ত্রীর মামলায় রেজাসহ ৫ অহরণকারী ও দুই ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়।
সুশান্তের স্ত্রী মাধবী রাণী মজুমদার জানান, তিনি আইন-কানুন ভালো জানেন না। পুলিশই এজাহার লিখে দিয়েছে, তিনি শুধু স্বাক্ষর করেছেন।
তবে পুলিশ বলছে, ভুক্তভোগী ও তার স্ত্রী মামলার এজাহার তৈরি করেছেন।
এদিকে মঙ্গলবার রেজার ছবি নিয়ে সুশান্তের কাছে গেলে তিনি রেজাকে শনাক্ত করেন। পরে ছবি নিয়ে তেরখাদার আজগড়া গ্রামে গেলে সবাই তাকে রেজা মাহমুদ বলে জানায়। তার বাবার সাম শামসুর রহমান।
তেরখাদা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি লাবু বিশ্বাস বলেন, রেজা প্রথমে আজগড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। পরের কমিটিতে আহ্বায়ক হয়। ৫ আগস্টের পর এলাকায় সে অত্যন্ত বেপরোয়া এবং নানান অপকর্ম করছে বলে তথ্য পাচ্ছি।’
লাবুর পরে উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক বর্তমানে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি জানান, তার সময় রেজা ইউনিয়ন ছাত্রদলের আহ্বায়ক ছিলেন।

ফেসবুকে বিএনপি ও যুবদল নেতাদের সঙ্গে রেজার অসংখ্য ছবি রয়েছে। জেলা যুবদল নামে একটি ফেসবুক পেজও পরিচালনা করেন তিনি।
অবশ্য জেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইবাদুল হক রুবায়েত বলেন, ‘রেজা ভালো ছেলে নয়। সবার সঙ্গে ছবি তুলে ভাঙিয়ে খায়। ওর সঙ্গে যুবদলের কোনো সম্পর্ক নেই।’
রাজনৈতিক পরিচয় জেনে চাপে ছিল পুলিশ
রোববার রাতে সুশান্তকে উদ্ধারে পুলিশের একাধিম টিম অংশ নেয়। তাদের এক কর্মকর্তা জানান, রাতেই রেজার পরিচয় শনাক্ত হয়। কিন্তু পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের আন্দোলনের মধ্যে ছাত্রদলের সাবেক নেতাকে গ্রেপ্তার নিয়ে চাপ অনুভব করছিলেন সবাই। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গোঙানীর ছবি ছড়িয়ে পড়ায় আসামিদের গ্রেপ্তারে প্রচন্ড সামাজিক চাপ ছিল।
কেএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আবু রায়হান মোহাম্মদ সালেহ বলেন, অপরাধীর পরিচয় সে অপরাধী। রেজাসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
প্রধান অভিযুক্ত রেজা ঘটনার পর থেকে পলাতক। তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে। তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খুলনা গেজেট/হিমালয়