খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  জুলাই গণহত্যা : ৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ
  বিশ্বকাপ বাছাই : মার্টিনেজের ভলিতে পেরুর বিপক্ষে জয় পেল আর্জেন্টিনা
ঝরে পড়ছে উপকূলের শিশুরা

সাতক্ষীরায় রোধ করা যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক, জসাতক্ষীরা

সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে উপকূলীয় এলাকায় বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে উপকূলীয় শিশুরা।

শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে উপজেলার ৪৬টি বিদ্যালয়, ৩৬টি মাদ্রাসা ও ৩টি কারিগরি (ভোকেশনাল) বিদ্যালয়ে মোট ৫ হাজার ৬৫৭ জন শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিল। ওই বছরের পরীক্ষার্থীরাই ২০২৩ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। আর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র ৩ হাজার ২৯৩ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ওই ব্যাচের কমপক্ষে ২ হাজার ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

শিক্ষকরা জানান, ছেলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দরিদ্রতা এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে মূলত দায়ী বাল্যবিবাহ। বিয়ে হওয়ার পরে ছাত্রীদের পক্ষে পড়াশোনা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে মেয়ে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক আর্থিক দুরবস্থার কারণে দ্রুতই শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। যদিও গত কয়েক বছর সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে এ চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সরকার উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে বই দেওয়াসহ নানা উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মেয়েদের অংশগ্রহণ ও টিকে থাকার হার বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।

তবে ব্যতিক্রম চিত্র লক্ষ্য করা যায় ছেলে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। মূলত দারিদ্র্যের কারণেই ঝরে পড়া এসব ছেলে শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা। পরিবারের ভরণ-পোষণের তাগিদে জীবিকা উপার্জন করতে গিয়ে ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থী শিশুশ্রমের শিকার বলে দাবি তাদের। এছাড়াও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। এ থেকে গড়ে উঠছে ছোট ছোট কিশোর গ্যাং অপরাধী।

শ্যামনগর উপজেলায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি প্রশাসনের সহায়তায় এ বছর উপজেলায় ৩টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে ।

ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচির (বিএলসি) উপজেলা কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন বলেন, অনেক সময় অভিভাবকেরা দূরে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মেয়ের বিয়ে দেন। ফলে সব বিয়ে রোধ করা সম্ভব হয় না।
উপজেলার প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩৪টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়। তবে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, বহু বিয়ে প্রশাসনের অগোচরে হয়ে গেছে।

উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের সাপখালী গ্রামের এক দরিদ্র অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি এক আত্মীয়ের কথা শুনে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে বিয়ে দেন ২০২১ সালে। মাত্র চার মাসের মাথায় মেয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এখন মেয়েটি বাপের বাড়িতেই থাকে। তার পড়াশোনাও আর হয়নি।

শ্যামনগরের সদর ইউনিয়নের (শ্যামনগর পৌরসভা) মাহমুদপুর গ্রামের জোবেদা সোহারাব মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয় ২০২২ সালে। ফলে তার পড়াশোনাও আর হয়নি। তার পিতার দাবি ভালো সম্বন্ধ পেয়েছি তাই আর দেরি না কওে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।

কৈখালী ইউনিয়নের সাপখালী গ্রামের মোস্তফা গাজী বলেন, তার ছেলেকে পারিবারিক অসচ্ছলতা ও দরিদ্রতার কারণে বেশি পড়াশোনা করাননি তিনি। সপ্তম শ্রেণীর পর তাকে ইট ভাটায় পাঠিয়ে দেন কাজে। এ বছরও কাজ করার জন্য ইট ভাটা মালিকপক্ষের নিকট থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছেন তাকে কাজে পাঠানোর জন্য।

শিশুশ্রমের কথা বলায় তিনি বলেন, ওসব আমরা বুঝি না। কাজ করতে হবে, কাজ না করলে পেটে ভাত জুটবে না। অভাব অনটনের সংসারে একার পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব না। তাছাড়া লেখা পড়া শিক্ষে আমাদেও সন্তানরাতো আর চাকরি বাকরি করতে পারবেনা। তাই ছেলেকে আগেভাগে কাজে লাগিয়েছি।

জোবেদা সোহরাব মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুস সাত্তার বলেন, তার বিদ্যালয়ের ৯৭ জন শিক্ষার্থী ২০২০ সালে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত ছিল। নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ৯ জন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। পাঁচজন ছেলে পড়ালেখা বাদ দিয়েছে। জানতে পেরেছি দরিদ্রতার কারণে অভিভাবকরা তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটায় শ্রমিক হিসাবে ও স্থানীয় বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজে যোগদান করিয়েছেন। ২০২৩ সালে ৭২ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে।

কৈখালী শামছুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শেখ সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে ২০২০ সালে ৮৭ জন শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিল। এবার ৫৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বাকি ৩৩ জন ঝরে পড়েছে। এদের অধিকাংশেরই বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে জড়িয়ে গেছে।

শ্যামনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নকিপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণানন্দ মুখার্জী বলেন, তাঁর বিদ্যালয়েও বাল্যবিবাহের কারণে কয়েকজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তবে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েও বেশ কয়েকজন ছাত্রী এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে বলে জানান তিনি।

তবে বাল্যবিবাহ আগের তুলনায় কমেছে দাবি করে তিনি জানান, বাল্যবিবাহের হার আগের তুলনায় কমলেও শিশু শ্রমের হার বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে প্রতিবছর আমাদের এ উপকূলীয় এলাকা থেকে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন ইটভাটাসহ অন্যান্য পেশায় কাজে চলে যাচ্ছে পড়াশোনা বাদ দিয়ে। ৬ মাস ইটভাটায় কাজ শেষ করে তারা আর পড়াশোনায় যোগ দিচ্ছে না। এতে ঝরে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। পরে এইসব ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। গড়ে উঠছে ছোট ছোট বহু কিশোর গ্যাং।

শ্যামনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ তেজারাত বলেন, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসন, শিক্ষক, এনজিওসহ সমাজের অনেক সচেতন মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন। স্কুলগুলোতে সমাবেশ করে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। কুফল তুলে ধরা হচ্ছে। এরপরেও আর দরিদ্রতা ও পরিবারের অসচেতনতার কারণে রোধ করা যাচ্ছে না। তবে আগের তুলনায় বাল্যবিবাহের হার কমছে।

তবে শিশুশ্রমের হার না কমায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি বলেন, শীতকালে (ইট ভাটার সিজনে) পরিবারের সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইট ভাটায় কাজ করতে যায় অনেক শিশু। পরে কাজ শেষ করে এসে তারা আর পড়াশোনায় যোগ দেয় না। এতে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ঝরে পড়ছে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)মো. আক্তার হোসেন বলেন, সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেশি। বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসন থেকে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করাও হচ্ছে। তবে উদ্বেগজনক হারে শিশু শ্রমের হার বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দরিদ্রতার কারণে পারিবারিকভাবে শিশুরা শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে।

খুলনা গেজেট/ টিএ

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!