কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে সাতক্ষীরায় চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি গবাদি পশু লালন-পালন করা হয়েছে। জেলায় পশুর মজুত বৃদ্ধি পাওয়ায় নায্য দাম নিয়ে খামারিরা শঙ্কায় রয়েছেন। চলতি বছর গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় গরু মোটাতাজাকরণে ব্যয় বেড়েছে অনেক। সে অনুযায়ী দাম না পেলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন খামারিরা।
তবে স্থানীয় প্রাণীসম্পদ বিভাগ বলছে, এ বছর সাতক্ষীরায় চাহিদার চেয়েও দ্বিগুণ কোরবানির পশু মজুত রয়েছে। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাইরের জেলাগুলোতেও সরবরাহ করা হবে। একারনে লোকশানের মুখে পড়তে হবেনা জেলার খামারিদের।
সাতক্ষীরা প্রাণীসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, এবার জেলায় কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ৯০৭টি। আর কোরবানির জন্য মোট পশু মজুত রয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৫টি। যা চাহিদার চেয়ে ৪৭ হাজার ৯৮টি পশু বেশি। জেলার সাত উপজেলার ৯ হাজার ৯৩০টি খামারসহ পারিবারিকভাবে এসব পশু লালন পালন করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ২৮ হাজার ৮০৩টি, ছাগল ৭৪ হাজার ৪৯৯টি, ভেড়া ৩৭০৭টি ও মহিষ রয়েছে ৯৯৬টি।
জেলার একাধিক খামারি বলেন, গত দু’বছর মহামারি করোনার মধ্যে কোরবানি ঈদ কেটেছে। ফলে লকডাউনসহ অর্থনৈতিক কারণে কোরবানি কম হয়েছে। পশু বিক্রি কম হওয়ায় সেইসময় তাদের লোকসান গুনতে হয়। তবে এবছর কোরবানি ঈদে করোনার প্রভাব তেমন একটা না থাকলেও গত দু’বছরের মতো এবারও লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তারা। কারণ হিসেবে বলেন, দেশে গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় এমনিতেই বিপাকে রয়েছেন তারা। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কাঙ্খিত মূল্য প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন খামারিরা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের উত্তর, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা। আর বন্যাদুর্গত ওই সমস্ত এলাকার অনেক খামারি গো-খাদ্য ও শুকনো জায়গার অভাবে ইতিমধ্যে লোকসান দিয়ে তাদের গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর কারনে বাইরের পশু বেপারিরা সাতক্ষীরার স্থানীয় পশুর হাট গুলোতে আশার সম্ভাবনা রয়েছে খুবই কম। তারউপর একদিকে জেলায় চাহিদার তুলনায় কোরবানি পশুর জোগান বেশি, অপরদিকে চড়া দামে খাবার কিনে পশুকে খাওয়ানো হয়েছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মানুষের হাতে এখন টাকা নেই। তাছাড়া গত বছরের তুলনায় এবার দাম একটু বেশি হওয়ায় অনেকেই কোরবানি করছেন না। আবার গত বছর যারা একটি গরু করোবানি করেছিল, এবার তারা অনেকে ভাগে কোরবানি করছেন। তাই পশু বিক্রি ও নায্য দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে তাদের। এই অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ থেকে গরু এলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলেও জানান খামারিরা।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খামারি শহিদুল ইসলাম বলেন, বিগত কয়েক বছরধরে গরু পালন করে আসছেন তিনি। বর্তমানে তার খামারে দেশি ও বিদেশি জাতের ১৮টি গরু রয়েছে। খামারটি এতদিন ভালো চললেও গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি।
কারন হিসেবে তিনি বলেন, আশায় ছিলেন গো-খাদ্যর দাম বেশি হওয়াতে পশুর দামও বাড়বে। কিন্তু, খামারটিতে গরু ক্রয়ের জন্য এখনও পর্যন্ত বাইরে থেকে কোন বেপারি আসেননি। স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকজন বেপারি আসলেও প্রত্যাশিত দাম বলছেন না তারা। ফলে দামে গবাদি পশু বিক্রি করতে না পারায় লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানান তিনি।
ভোমরা এলাকার খামারি রেজাউল ইসলাম বলেন, আগে বছরে ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করলেই একটা গরু পোষা যেত। এখন গো-খাদ্যের এত দাম যে, মাসে খরচ সাত হাজার টাকা পড়ে যাচ্ছে। তাই খরচ বেশি হওয়ায় কোরবানির বাজারে খামারিরা বেশি দাম চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মানুষের হাতেও টাকা কম। ফলে পশুর দাম কেমনে উঠবে তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।
এবিষয়ে সাতক্ষীরা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এবিএম আব্দুর রউফ বলেন, এবছর সাতক্ষীরায় চাহিদার চেয়ে প্রায় দিগুণ কোরবানির পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কোরবানির পশু কেনাবেচা শুরু হয়েছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৪৮ হাজার পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। যা জেলার বাইরের বেপারিরা কনতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, সারা বছর খামারিরা অপেক্ষায় থাকেন, কোরবানির সময় আসলে কিছু লাভবান হওয়ার আশায়। তবে একদিকে চাহিদার চেয়ে পশুর যোগান বেশি তারউপর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হওয়ায় সেখানে অপেক্ষাকৃত কম দামে পশু বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভাব কিছুটা হলেও জেলার বাজারে পড়বে। তবে পদ্মা সেতু হওয়ায় খামারিরা ইচ্ছে করলে কম সময়ের ভিতরে দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে তাদের গরু সরবরাহ করতে পারবেন। একারনে লোকশানের মুখে পড়তে হবেনা খামারিদের।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ন কবির বলেন, কোরবানি ঈদকে ঘিরে সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করা হচ্ছে। জেলার কোন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতীয় চোরাই গরু দেশে প্রবেশ ঠেকাতে এবার কঠোর অবস্থানে রয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলার খামারীরা যাতে কোন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ভারতীয় চোরাই গরুর প্রবেশ ঠেকাতে ইতিমধ্যে বিজিবি’র প্রথক দু’টি ব্যাটালিয়নকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তারা যেন সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করে। আর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পশুর হাটগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত সার্বক্ষণিক মাঠে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, যদি কোন ক্রেতা-বিক্রেতারা নগদ টাকা পরিবহনে অসুবিধা মনে করেন, তাহলে তারা জেলা প্রশাসনের সহায়তা নিতে পারবে। বড় ধরনের নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রেও জেলা প্রশাসনের সহায়তা থাকবে। আশা করছি এবার জেলার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে নিরাপদে তাদেও পশু ক্রয়-বিক্রি করতে পারবেন।