খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ইস্টার সানডে উপলক্ষে ইউক্রেনে ৩০ ঘণ্টা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা পুতিনের
  নারী বিশ্বকাপের মূলপর্বে বাংলাদেশ
  জনগণই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে : মির্জা ফখরুল
  আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে সর্বোত্তম: প্রধান উপদেষ্টা

সাংবা‌দিক ম‌নিরুল হুদার ই‌ন্তেকাল, কাল খুলনায় জানাযা ও দাফন

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুলনা পৌরসভার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, প্রথিতযশা কর আইনজীবী, সিনিয়র রোটারিয়ান মনিরুল হুদা আজ সকালে ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। আজ জুম্মা বাদ ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদে মরহুমের প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

আগামীকাল শনিবার বাদ জোহর খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে মরহুমের দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। পরে টুটপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হবে।

তাঁর ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশসহ মরহুমের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে‌ছে খুলনা গে‌জেট প‌রিবার।

ঢাকায় অবস্থানরত দৈনিক জন্মভূমির প্রকাশক আসিফ কবির জানান, মরহুমের প্রবাসী কন্যারা আজ রাতে অথবা শনিবার সকালে ঢাকায় পৌছােবে। এরপরই মরদেহ খুলনায় রওনা হবে। মরহুমের পরিবারের পক্ষে খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা জানাযা ও দাফন কাজ তদারকি করছেন।

মনিরুল হুদা খুলনার সকল স্তরের মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছি‌লেন, ছি‌লেন আস্থার প্রতীক। খুলনার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তী। এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের গর্ব ও অহংকারের অগ্রজ সহকর্মী। তিনি দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ। পাকিস্তান পর্বে এবং বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের নানান ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি তিনি সংবাদপত্র জগতে পদচারণা করে চলেছেন। এ গর্ব দক্ষিণাঞ্চলবাসীর। খুলনার সাংবাদিকতায় এক অনন্য ইতিহাস। ৭০ বছর সংবাদকর্মী হিসেবে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ একমাত্র তিনি। দীর্ঘ সময়ে খুলনার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিল্প-কলকারখানা স্থাপন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পীর খানজাহান আলী (র.) সেতু, মেডিকেল কলেজ, বিমান বন্দর, শহর রক্ষা প্রকল্প, মংলা বন্দর আধুনিকায়ন, সর্বোপরি সুন্দরবনকে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি ধীমান সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নানামূখী প্রতিভা দৃশ্যমান। তিনি ভাষা সৈনিক, সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক নেতা, আয়কর আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।

বৃটিশ শাসনামলে মনিরুল হুদা বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ১৯৩৭ সালের ২৭ নভেম্বর। মরহুম সামছুল হুদা তাঁর পিতা। তিনি বাগেরহাটে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। মরহুমা আমেনা খাতুন তাঁর মা। তাঁর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্বটি কেটেছে বাগেরহাটে। সেখানেই তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। একই বছর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকায় বাগেরহাট থেকে ডাকযোগে সংবাদ পাঠাতে শুরু করেন। নিছক কৌতুহল বশত: খবর লিখে পাঠানো, পরবর্তীতে তা ছাপার অক্ষরে দেখা এবং তা-ই সারাজীবন নেশার মতোই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে।

শুরুর পর্বে স্বাভাবিকভাবে তিনি ছিলেন খন্ডকালীন সংবাদদাতা। পেশাজীবী নন। তবে ওটাই তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় বাগেরহাট থেকে মাসিক বিদ্যুৎ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ঢাকা হতে একুশে সংকলন প্রকাশিত হয়। আর সারা পূর্ব-পাকিস্তানের জেলা-মহকুমা পর্যায়ে অসংখ্য সংকলন প্রকাশিত হতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরেও অনেকদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে এরকম অগণিত পত্রিকা, স্মরণিকা প্রকাশিত হতো। মনিরুল হুদা সম্পাদিত বিদ্যুৎ নামের পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো। পর পর আট সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর মনিরুল হুদা উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান রাজশাহী কলেজে। ফলে বাগেরহাট হতে বিদ্যুৎ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

এর আগেই ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বরের একটি ঘটনা তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা। ওইদিন চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পশুর নদীর জয়মনির গোল-এ “সিটি অব লিয়ন্স” নামের একটি বিদেশী জাহাজ নোঙ্গর করে। বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজটির ছবি তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন। তখন তিনি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। পিতা বাগেরহাট মহকুমার প্রশাসক। এ কারণেই তিনি বন্দরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর ধারণ করা ছবিটিই পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত ইয়ার-বুকে ছাপা হয়।

১৯৫৩ সালে মনিরুল হুদা বাগেরহাট টাউন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৫৭ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রত্যক্ষভাবে কখনোই রাজনীতির সাথে জড়িত হননি।
১৯৫৯ সালে তিনি আয়কর আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬-২০১৯ বাংলাদেশ ট্যাক্স ল’ইয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহের কারণেই ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি দৈনিক পাকিস্তান-এ যোগ দেন। আত্মপ্রকাশের প্রথম দিন থেকে ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ পত্রিকার ইতিহাসে তিনিই দীর্ঘদিনের কর্মী হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি করেন।

দৈনিক বাংলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বেশ কিছুদিন সংবাদপত্র হতে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। আবারও ২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারীতে তিনি দৈনিক জন্মভূমি’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। আমৃত‌্যু তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।

ব্যক্তিগত জীব‌নে তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্রের জনক ছি‌লেন।

খুলনা প্রেসক্লাবের শোক

বিশিষ্ট সাংবাদিক মনিরুল হুদার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন খুলনা প্রেসক্লাবের আহবায়ক এনামুল হক ও সদস্য সচিব রফিউল ইসলাম টুটুলসহ নির্বাহী পরিষদের সদস্যবৃন্দ।

খুবি উপাচার্যের শোক

খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, প্রবীণ সাংবাদিক মনিরুল হুদার ইন্তেকালে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. রেজাউল করিম।

এক শোকবার্তায় উপাচার্য বলেন, মনিরুল হুদা খুলনার সাংবাদিকতা জগতে এক উজ্জ্বল ও স্মরণীয় নাম। তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে সততা, নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গণমাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি শুধু সংবাদ পরিবেশনই করেননি, বরং সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর লেখনী ছিল সত্য ও আদর্শের প্রতিফলন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন নির্ভীক, নীতিবান ও আদর্শ সাংবাদিককে হারালাম, যা এই অঞ্চলের সাংবাদিকতা জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর কর্মপ্রেরণা ও সাংবাদিকতার আদর্শ নতুন প্রজন্মের জন্য এক জীবন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বিবৃতিতে উপাচার্য মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার, সহকর্মী, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

খুলনা গেজেট/জেএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!