খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  যাত্রাবাড়িতে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষে দুই পুলিশ আহত
  জুলাই গণহত্যা : ৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ

সম্পূর্ণ মুক্তিপণ না পেলে মুক্তি নেই লিবিয়াতে জিম্মি শ্যামনগরের ১০ যুবকের

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

মুক্তিপণের দাবিতে লিবিয়াতে জিম্মি করা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ১০ যুবকের অদ্যবধি মুক্তি মেলেনি। মুক্তিপণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না হওয়ায় লিবিয় মানব পাচারচক্রের জিম্মায় থাকা ওই যুবকদের ছাড়া হচ্ছে না। ফলে তাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তাদের পরিবারের সদস্যরা।

এদিকে জিম্মিদশা থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই যুবক ‘গেম’ দেয়ার নামে ভু-মধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ শুরুতে ঝামেলামুক্ত ও ভয়ডরহীনভাবে ইতালি পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তবে দুবাই পৌঁছানোর পর থেকে বিড়ম্বনার শুরু হয়ে লিবিয়া উপকূলে নেয়ার পর তা চরম আকার ধারণ করে। পরবর্তীতে আটশ কিলোমিটার সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য মাত্র সাড়ে ছয় হাত চওড়া ও আট হাত লম্বা নৌযানে চাপিয়ে রীতিমত মৃত্যুকূপে নামিয়ে দেয়া হয় তাদের।

আটকে পড়া যুবকদের বরাত দিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানিয়েছে, দালালদের তৎপরতা না থাকায় রাশিদুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, বাবলু মোল্যা, আব্দুর রহিম, আজিজুল কয়াল, রফিকুল ইসলাম, আসমত, রায়হান, সালামিন, শাহাজান ও মিলনসহ শ্যামনগরের ২০ যুবক এখনও কারারুদ্ধ। এছাড়া হাসান, বায়েজিদ, কাদের, রায়হান, মিলন ও রুমিসহ আরও কিছু যুবক আত্মগোপন করে নিজেদের রক্ষাসহ পরবর্তী ‘গেম’ ধরার চেষ্টা করছেন। তবে দাবিকৃত সম্পূর্ন ৩৫ লাখ টাকা না মেলায় জিম্মি মামুন কয়াল, মিঠু, আব্দুস সামাদ, রাসেল হোসেন, দেলোয়ার, নরিম, আনারুল, জামিরুলদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে জিম্মি যুবকদের পরিবারসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলে নিশ্চিত তথ্য মিলেছে সাগর পথে মানব পাচারচক্রের সাথে স্থানীয় রাঘববোয়ালরা জড়িত। আত্মীয় পরিজন ও সন্তানরা ইতালি ও লিবিয়ায় অবস্থানের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধ এ ‘র‌্যাকেট’ গড়ে উঠেছে। গত দুই বছরে এ চক্রের হাত ধরে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী, রমজাননগর ও ঈশ্বরীপুরের অর্ধশতাধিক তরুণ/যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে পাচার হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার বৈশখালী গ্রামের ওমর আলী, শ্রীফলকাঠির হারুন, ধুমঘাটের মনিরুল ও সেকেন্দার এবং কৈখালীর কুমিরমারী গ্রামের নুর ইসলাম এ চক্রের হোতা। তাদের সন্তান, জামাতা ও নিকটাত্মীয়রা ইতালি থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় তরুণ ও যুবকদের প্রলুব্ধ করে তারা সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রেরণ করে। এই চক্রের সাথে শ্যামনগর উপজেলার বাইরের মুরাদ ও জিয়া নামের আরও দু’জন জড়িত।

স্থানীয়দের দাবি ওমর আলী, সেকেন্দার, নুর ইসলামরা ‘শিকার’ সংগ্রহ করে ঢাকায় হারুনের হাতে তুলে দেয়। পরবর্তীতে হারুন ঢাকা থেকে লোকজন নিয়ে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় মনিরুলের কাছে পৌঁছে দেয়। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে ‘গেমে’ দেয়ার পর ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি উপকূলে পৌঁছালে চক্রের বাকি সদস্যরা তাদের গ্রহণ করে। স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করার জন্য ‘শিকার’ প্রতি ওমর আলীরা এক লাখ টাকা পর্যন্ত ভাগ পেয়ে তাকে।

কৈখালী গ্রামের রফিকুল ইসলামসহ স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানায়, ওমর আলীর ছেলে কামরুল ও জামাই ওসমান ইতালী প্রবাসী। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুই মাস আগে তিনি স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি আব্দুল বারী, বাবু ও আহম্মদ আলীকে নির্বিঘ্নে সাগর পথে ইতালি পাচার করে। একইভাবে বৈশখালী গ্রামের আব্দুস সালাম মিস্ত্রির ছেলে আনারুল ইসলাম ও কৈখালী গ্রামের আমির আলীর ছেলে জামির আলী জামুকে পাচার করা হলেও লিবিয়ায় গিয়ে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছে।

একইভাবে নুর ইসলাম মাওলানা নামের চক্রের অপর সদস্য ইতালী প্রবাসী জামাই-মেয়ের মাধ্যমে এবং সেকেন্দার তার ভাই মনিরুল ও হারুনের সহায়তায় আরও ১৯ জনকে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। ইতালি পাড়ি জমানোর প্রলোভনে পড়ে বর্তমানে কারান্তরীণ ও জিম্মি অবস্থায় থাকা এসব যুবক ও তরুণ শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী মল্লিকপাড়া ও মানিকখালী, ঈশ্বরীপুর, ধুমঘাট এবং সরদার গ্যারেজ এলাকার বাসিন্দা।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানায়, ইতালি পৌঁছে দেয়ার জন্য শুরুতে নয় থেকে সাড়ে নয় লাখ টাকায় চুক্তি করে চক্রের সদস্যরা। পরবর্তীতে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার পর নানা অজুহাতে আরও দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আদায় করে তারা। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বল্প দিনের মধ্যে ‘গেম’-এ তুলে দেয়ার কথা বলে আরও এক দেড় লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হয়। এছাড়া স্থানীয়ভাবে ‘শিকার’ খুঁজে বের করা বা তথ্যদাতাদের মাথাপিছু বিশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা করে দেয় চক্রটি।

লিবিয়ার কারাগারে আটক আসমতের পিতা জাকির হোসেন জানান, ছেলের জন্য তিন দফায় ১৩ লাখ টাকা নিয়েছে চক্রটি। কারাগারে যাওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশী মুদ্রায় বিশ/বাইশ হাজার টাকা খাওয়ার জন্য টাকা পাঠাতে হচ্ছে তাকে।

আবার জিম্মি যুবকদের খাওয়ানোর জন্য বাড়ি থেকে সপ্তাহান্তে টাকা দিতে হচ্ছে বলে জানায়, সরদার গ্যারেজের আব্দুল কাদেরের ভাই মোঃ আব্দুর রাজ্জাক।

নৌ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে লিবিয়া কারাগারে আটক ও বাইরে পলাতক যুবকদের ভাষ্যমতে, অতি ছোট একটি নৌযানে গাদাগাদি করে তাদের বসিয়ে দেয়া হয়। নৌযান ছোট হওয়ায় ঠিকমত নড়াচড়া পর্যন্ত করা যায় না গোটা সাগর পাড়ি না দেয়া পর্যন্ত। সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাদের নিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত ত্রুটিপূর্ণ একটি নৌযানে চার দালাল মিলে ৫৩ জনকে ‘গেম’ দেয়া হয়। প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার যাওয়ার পর উত্তাল সাগরের ঢেউয়ে তাদের নৌযান ক্ষতিগ্রস্থ হলে ভয়ে ফিরে আসে তারা। এসময় কয়েকজন পুলিশের হাতে আটক হলেও অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ‘গেম’ দেয়ার আগে সাগরে ডুবে মারা গেলে “অভিযোগ থাকবে না” মর্মে পরিবারের নিকট থেকে অঙ্গীকার আদায় করা হয় বলেও জানায় কারাবন্দী এক যুবকের পিতা।

এদিকে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পার হলেও জিম্মি ও কারাগারে আটক বন্দীদের উদ্ধারে দালাল চক্রের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই। বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নিজেদের উদ্যোগে বিকল্প ব্যবস্থাপনায় সন্তানদের উদ্ধারে চেষ্টা করছে। এঘটনার পর মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সেকেন্দারসহ অন্যরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। তবে চক্রের মুল হোতা হারুন, ওমর আলী ও মনিরুলরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। হারুন ঢাকায় ও মনিরুল লিবিয়ায় বসে স্থানীয় পর্যায়ে ওমর আলীকে দিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে।

নাম প্রকাশ না করার ওমর আলী চক্রের একজন জানান, ইতিমধ্যে কিছু টাকা সংগ্রহ হয়েছে। আরও ১৫/২০ লাখ টাকা জোগাড় করে দু’তিন দিনের মধ্যে জিম্মি যুবকদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।

এদিকে ভিনদেশে বৈরী পরিস্থিতিতে পড়া সন্তানদের জন্য ভুক্তভোগী পরিবারগুলোতে চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা ভর করেছে। জিম্মি সন্তানের মুক্তিপণের পাশাপাশি খাবারের টাকা দিতে যেয়ে ধার দেনা করার কথা জানিয়েছেন তারা।

ভুক্তভোগি এক পরিবারের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিন দফায় টাকা দেয়ার পর এখন ‘গেম’ পায়নি তার ভাই। বাধ্য হয়ে সেখানে অলস বসে থাকায় প্রতিদিনের খাবারের খরচ বাড়ি থেকে পাঠাতে হচ্ছে।

জিম্মি অবস্থায় থাকা তরুন রাসেলের পিতা আব্দুর রশিদ বলেন, চাহিদামত টাকা দিতে না পারায় তার ছেলের উপর প্রচন্ড ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে।

কৈখালী কয়াল পাড়ার আজিজুল ইসলামের স্ত্রী জানান, মারধরের কারণে তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জীবিত অবস্থায় বাড়িতে ফেরার বিষয়ে তারা শংকায় রয়েছেন।

আইন প্রয়োগকারী একাধিক সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আটকে পড়া যুবকদের পরিণতি নিয়ে শংকায় রয়েছে প্রতিটি পরিবার। সন্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তবে অবৈধ এসব পাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নেয়ার জন্য প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভুক্তভোগীদের কেউ থানায় অভিযোগ দিচ্ছে না। তবে বিষয়টি নিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। মানব পাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নেয়ার চেষ্টা চলছে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!