খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ৪ দিনের সরকারি সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি দল
  পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৪৫

শয়ন ও ঘুমানোর আদব (পর্বঃ ৩২)

হাফেজ মাও. মুফতি জুবায়ের হাসান

মুসলিম ব্যক্তি মনে করে- ঘুম মানব জীবনের অন্যতম নিয়ামত, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَمِن رَّحْمَتِهِۦ جَعَلَ لَكُمُ الَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِن فَضْلِهِۦ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। -সূরা কাসাস, আয়াতঃ ৭৩
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا
তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। -সূরা নাবা, আয়াতঃ ০৯
কারণ, দিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতের বেলায় বান্দার বিশ্রাম তার শারীরিক প্রাণচাঞ্চল্যতা প্রবৃদ্ধি ও উদ্যমের জন্য সহায়তা করে, যাতে সে তার কর্তব্য পালন করতে পারে, যার জন্য তাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এ নিয়ামতের কৃতজ্ঞতার বিষয়টি মুসলিম ব্যক্তির কাছে জরুরি ভিত্তিতে দাবি করে, সে যেন তার ঘুমানোর ব্যাপারে নিম্নোক্ত আদবসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখেঃ

১. ইলমী আলোচনা, মেহমানের সৌজন্যে কথপোকথন অথবা পরিবারের দেখাশুনার মত কোন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এশার নামাযের পর ঘুমকে বিলম্বিত না করা; হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এশার নামাযের পূর্বে ঘুমানো এবং তার (এশার নামাযের) পরে কথা বলা অপছন্দ করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস-৫৬৮

২. অযু করা ব্যতীত ঘুমানোর চেষ্টা না করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ হযরত বারা ইবনে আযেব রা. কে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তখন অযু করে নাও, যেমনিভাবে তুমি নামায আদায়ের জন্য অযু করে থাক।

৩. ঘুমানোর শুরুতে তার ডান কাতে শুয়ে পড়া এবং তার ডানপাশকে বালিশরূপে ব্যবহার করা; আর পরবর্তীতে (ডান কাত থেকে) নিজেকে বাম কাতে পরিবর্তন করাতে কোন দোষ নেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস-৬৩১১

৪. রাতে অথবা দিনে ঘুমানোর সময় উপুড় হয়ে না শোয়া; কেননা, হাদিস শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ مَرَّ بِيَ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ وَأَنَا مُضْطَجِعٌ عَلَى بَطْنِي فَرَكَضَنِي بِرِجْلِهِ وَقَالَ يَا جُنَيْدِبُ إِنَّمَا هَذِهِ ضِجْعَةُ أَهْلِ النَّارِ
হযরত আবূ যার রা. থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় নবী করিম ﷺ আমার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে তাঁর পা দ্বারা খোঁচা দিয়ে বলেন, হে জুনাইদিব! এটা তো জাহান্নামের শয়ন। -সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস-৩৭২৪
অপর এক রেওয়ায়েতে এসেছে, এটা এমন শোয়া, যা আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন বা ঘৃণা করেন।

৫. হাদিসে বর্ণিত যিকির বা দুআসমূহ পাঠ করা; যেমন:—
(ক) তেত্রিশ বার سُبْحَانَ اللهِ ؛ وَالحَمْدُ للهِ ؛ وَاللهُ أكْبَرُ বলবে; অতঃপর বলবে,
لا إلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ ؛ وَلَهُ الحَمْدُ ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই এবং সকল প্রশংসাও তাঁর; আর তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
হযরত ফাতেমা ও আলী রা. যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে তাদের ঘরের কাজে সহযোগিতার জন্য একজন খাদেম প্রাপ্তির আবেদন করলেন,
তখন তিনি তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমরা যা আবেদন করেছ, আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়ে উত্তম কিছু শিখিয়ে দিব না? যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহু আকবার ৩৩ বার, সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আল্‌হামদুলিল্লাহ ৩৩ বার পড়বে। এটা তোমাদের জন্য একটি খাদিমের চেয়েও অধিক কল্যাণকর। আল্লামা ইবনু সীরীন রহ. বলেনঃ তাসবীহ হলো ৩৪ বার। -সহীহ বুখারী, হাদীস-৬৩১৮
(খ) সূরা আল-ফাতিহা, সূরা আল-বাকারার প্রথম আয়াত থেকে المفلحون পর্যন্ত, আয়াতুল কুরসি এবং সূরা আল-বাকারার শেষ অংশ— لله ما في السموات থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত পড়া। এ ব্যাপারে হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
(গ) শোয়ার সময় সর্বশেষ এ দুআটি পাঠ করা, যা নবী ﷺ থেকে বর্ণিতঃ
اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ، وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إِلَيْكَ، وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ، وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ، رَغْبَةً وَرَهْبَةً إِلَيْكَ، لاَ مَلْجَأَ وَلاَ مَنْجَا مِنْكَ إِلاَّ إِلَيْكَ، آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ، وَنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ

৬. ঘুমন্ত ব্যক্তি যখন সকাল বেলায় উপনীত হবে, তখন নিম্নোক্ত যিকির বা দুআসমুহ পাঠ করবেঃ
(ক) ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে বিছানা থেকে উঠার পূর্বে বলবে:
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
অর্থঃ সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দান করার পর পুনরায় জীবন দান করেছেন; আর তাঁরই নিকট (আমাদেরকে) ফিরে যেতে হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস-৬৩২৪

(খ) যখন সে তাহাজ্জুদের নামায আদায়ের জন্য ঘুম থেকে উঠবে, তখন সে আকাশের দিকে তাকাবে এবং
إن في خلق السموات و الأرض
থেকে সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করবে; আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি আমার খালা নবী করিম ﷺ এর স্ত্রী মায়মূনা বিন্‌ত হারিস রা. এর ঘরে এক রাতে ছিলাম। তখন রাসূল ﷺ অর্ধরাত্রি কিংবা এর সামন্য পূর্ব অথবা সামান্য পর পর্যন্ত ঘুমালেন। তারপর তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন এবং দুই হাত দিয়ে মুখ থেকে ঘুমের আবেশ মুছতে লাগলেন; অতঃপর সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করলেন। তারপর ঝুলন্ত একটি পুরাতন মশকের কাছে গেলেন এবং তা থেকে সুন্দরভাবে অযু করলেন। এরপর নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস-১১৭

(গ) চারবার এ দো‘য়া পাঠ করবে,
للَّهُمَّ إِنِّي أَصْبَحْتُ أُشْهِدُكَ وَأُشْهِدُ حَمَلَةَ عَرْشِكَ وَمَلاَئِكَتَكَ وَجَمِيعَ خَلْقِكَ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُولُكَ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যে ব্যাক্তি এই দুআ একবার পাঠ করবে আল্লাহ তার এক-চতুর্থাংশ দেহ জাহান্নামের শাস্তি হতে মুক্তি দিবেন। আর যে ব্যক্তি তা দুইবার বলবে, আল্লাহ তার শরীরের অর্ধেক জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি দিবেন। আর যে ব্যক্তি তা তিনবার বলবে আল্লাহ তার শরীরের তিন-চতুর্থাংশ এবং চারবার বললে তার সমস্ত শরীর জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি দিবেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৫০৬৯

(ঘ) ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য যখন সে দরজার বাহিরে পা রাখবে, তখন বলবে:
بِسْمِ اللَّهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: যখন কোন ব্যক্তি তার ঘর হতে বের হওয়ার সময় উক্ত দুআ পাঠ করবে, তখন তাকে বলা হয়, তুমি হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছো, রক্ষা পেয়েছো ও নিরাপত্তা লাভ করেছো। সুতরাং শয়তানরা তার থেকে দূর হয়ে যায় এবং অন্য এক শয়তান বলে, তুমি ঐ ব্যক্তিকে কি করতে পারবে যাকে পথ দেখানো হয়েছে, নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে এবং রক্ষা করা হয়েছে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৫০৯৫

পরিশিষ্ট:
আল-হামদুলিল্লাহ, যাঁর অসীম অনুগ্রহে আমরা মুসলিম জীবনের আদব-শিষ্টাচার-এর নানা দিক নিয়ে প্রায় ৩২টি পর্বে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। আসলে শিষ্টাচার হলো মুসলিম জীবনের অলংকার; সুতরাং যে ব্যক্তি তার জীবনে যত বেশি ইসলামী আদব তথা শিষ্টাচারের সমাবেশ ঘটাতে পারবে, তার জীবন তত বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে এবং পরকালীন জীবনে তার নিশ্চিত সফলতা তো থাকছেই।

এ অধ্যায়ে আলোচিত কিছু আদব আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ মুস্তফা ﷺ এর সাথে সংশ্লিষ্ট; এসব আদব যথাযথ রক্ষা করে চলা মুসলিম ব্যক্তির ঈমানী দায়িত্ব এবং তার ব্যতিক্রম করলে তার ঈমানের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠবে! তাছাড়া আরও যেসব আদব বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে, সেগুলো একজন মুসলিম ব্যক্তি যথাযথভাবে পালন করতে পারলে সে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ অনেক কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং পাশাপাশি শরীয়ত প্রবর্তক কর্তৃক নির্দেশিত অনেক আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবে; এ সুবাদে একদিকে সে দুনিয়ার জীবনে একজন ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে, অপরদিকে পরকালীন জীবনে আল্লাহ তাআলার গ্রহণযোগ্য ও প্রিয় বান্দার কাতারে শামিল হয়ে চূড়ান্ত সফলতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর দেখানো পথে চলার তাওফীক দান করুন, আমীন! ছুম্মা আমীন!

লেখক : ইমাম ও খতিব
কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সদস্য, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!