খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ ফাল্গুন, ১৪৩১ | ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  পদত্যাগ করলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম
  জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম লিভ টু আপিলের অনুমতি পাবেন কিনা, শুনানি আগামীকাল
  তৎকালীন সরকারের যোগসাজশেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হবে : মির্জা ফখরুল

শোকাবহ পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস আজ, এবার পালন হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে

গেজেট ডেস্ক

রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে সেনা অফিসারদের নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞের ১৬ বছর আজ। শোকাবহ পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই দিনটিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করেছে। পিলখানার ভেতরে সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের পেছনে কি ছিল ষড়যন্ত্র? কেন এতগুলো অফিসারকে জীবন দিতে হলো? এই ষড়যন্ত্র উন্মোচনের চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য গঠন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’। এ পর্যন্ত কমিশন ৩৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। শহীদ সেনা পরিবারের পক্ষ থেকে ন্যায় বিচারের দাবিতে গঠন করা হয়েছে ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’।

ঘটনার সময় সেনা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইউটিউবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ওই দিনের ঘটনার অনেক কিছুই জানিয়েছেন। তার দাবি, তদন্তে সরকার তেমন সহায়তা করেনি। তবে পেছনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি। এদিকে দিনটি যথাযথভাবে পালনের জন্য সরকার ও বিজিবির পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা বা তাদের প্রতিনিধিরা বনানীর সামরিক কবরস্থানে শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধানরা (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। শ্রদ্ধা জানানো হবে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তাণ্ডব চালায়। ওই দু’দিনে যে ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে আছেন, তৎকালীন বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন সেনা অফিসার এবং নারী ও শিশুসহ আরও ১৭ জন। ১৬ বছর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারই ভিন্ন শহীদ সেনা দিবস পালন হচ্ছে।

সেদিন কি ঘটেছিল: হাইকোর্টে জমা হওয়া মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তৎকালীন বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায় সদর দফতরের দরবার হলে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপ-মহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।

দরবার শুরুর পর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দু’জন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে। এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়। পরদিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করে।

কতদূর এগুলো তদন্ত কমিশনের কাজ

পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিদেশি সংশ্লিষ্টতা এবং একই সঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টিও পর্যালোচনা করছে বিডিআর বিদ্রোহে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। গত বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদরদপ্তরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেনাসদস্যসহ ৩৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে কমিশন। কমিশন পাঁচটি কর্মপরিধি ঠিক করেছে। এখন পর্যন্ত যে ৩৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন লে. জেনারেল তিনজন, মেজর জেনারেল দুজন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পাঁচজন, কর্নেল চারজন, লে. কর্নেল চারজন, মেজর সাতজন, ক্যাপ্টেন দুজন, বিডিআর সদস্য সাতজন ও শহীদ পরিবারের সদস্য তিনজন।

কিছু বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি লেখা হয়েছে বলেও জানান ফজলুর রহমান। কমিশন জানায়, ১৬ বছর আগে সংঘটিত ঘটনার তথ্য উদঘাটন জটিল হলেও কমিশন অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদী শক্তির দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল পিলখানা হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, এটি কোনো বিদ্রোহ ছিল না, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের কবর রচনা করে নৈরাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিচার প্রক্রিয়া কতদূর:

পিলখানার বর্বোচিত এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। দেশের বিচারিক ইতিহাসে কোন মামলায় বহু আসামি নিয়ে এটিই একমাত্র মামলা। রাজধানীর পুরান ঢাকায় আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে হত্যা মামলাটির বিচার সম্পন্ন হয়। বিচারিক আদালত ওই মামলায় ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। উচ্চ আদালতের রায়ে ১৩৯ আসামির ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরও ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।

ওই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ আসামির বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলছে। বিস্ফোরক আইনের মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর অস্থায়ী আদালতে ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়ার আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। হত্যা মামলাটিতে খালাস ও জামিন প্রাপ্ত ১৬৮ জন আসামি এই আদালত থেকে জামিন পেয়ে চলতি মাসে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছেন।

ন্যায় বিচারের দাবিতে শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন: পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ সেনা পরিবারের সদস্যদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করেছে। সংগঠনটির নাম ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’। শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌস বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসটি অনেক কষ্টের। তারা দিন গুনতে থাকেন, মাসটি কখন শেষ হবে। সম্মিলিত শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মতিতে একটি শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আজ শহীদ সেনা দিবস: সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সরকারের পরিপত্রে বলা হয়েছে, সরকার প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ওই তারিখকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ (সরকারি ছুটি ব্যতীত) হিসেবে পালনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনসংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্রের ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!