যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর ‘বন্দি’ খুনের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ নয়, কর্মকর্তারা ঠান্ডা মাথায় কুকুরের মতো পিটিয়ে হত্যা করেছে কিশোর তিন বন্দিকে। তারা জল্লাদের মত জানালার গ্রিলের ভেতর ১৮ কিশোর বন্দির হাত ঢুকিয়ে বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে পা বেঁধে লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে মারপিট করে। এরপর অচেতন হয়ে গেলে তাদের কাউকে রুমের ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে দেয়। নির্মম এ নির্যাতনের শিকার ১৪ কিশোর বর্তমানে জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মারা গেছে তিন কিশোর। হাসপাতালে আহতদের বর্ণনায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পেলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য স্বীকার করেনি। তবে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ ঘটনাকে একপক্ষীয় বলে মন্তব্য করে গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটনার পর রাতে যশোরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে যান। গভিররাত পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি নাহিদুল ইসলামও আসেন। রাত তিনটার দিকে তিনি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি চুয়াডাঙ্গার পাভেল বলে, ‘গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলে। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় দুইশ’ জনের চুল কেটে দেয়ায় আমার হাত ব্যথা ছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেয়া হবে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে কয়েক কিশোর তাকে মারধর করে। বিষয়টি হেড গার্ড অফিসে জানায়। সেখানে নূর ইসলাম অভিযোগ করেন, কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে, তারা মাদক সেবন করেনি।
পাভেল জানায়, ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে আমাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আমরা ঘটনার আদ্যোপান্ত জানানোর এক পর্যায়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্য স্যাররা আমাদের বেধড়ক মারপিট শুরু করে। আহত আরেক কিশোর নোয়াখালীর বন্দি জাবেদ হোসেন জানায়, স্যাররা ও অন্য বন্দি কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছে। তারা জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে তা বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে মারধর করে।
অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমের ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে দেয়। জ্ঞান ফিরলে ফের একই কায়দায় মারপিট করে।
যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দি ঈশান বলছে, নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার (রাসেলের) জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে।
ঈশান অভিযোগ করে, প্রবেশন অফিসার মারধরের সময় বলে, তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে। আহতরা জানায়, মারধর করে তাদের এখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর রাত আটটা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় আহতদের হাসপাতালে আনা হয়।
তবে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ দাবি করেন, সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড ও লাঠির আঘাতে মারাত্মক জখম হয় ১৭ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রে তাদের চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা চলে। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরমধ্যে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
এ বিষয়ে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম সংবাদকর্মীদের বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্খিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু পথযাত্রীরা কেউ মিথ্যা কথা বলে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যে কারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো বলেন, মামলা হবে, সেই মামলার বাদী যে কেউ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা বা তাদের স্বজন অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষ, সর্বশেষ কাউকে না পাওয়া গেলে পুলিশ তো রয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনা একপক্ষীয় বলেও জানান অতিরিক্ত ডিআইজি।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। এসময় তিনি সংবাদকর্মীদের বলেন, কী কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। আমরা তদন্ত কমিটি করে দেবো। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বৃহস্পতিবার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে মারপিটের ঘটনায় তিন বন্দি কিশোর নিহত হয়। এসময় আহত হয়েছে অন্তত ১৭ জন। আহতদের পুলিশ উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে।
জেনারেল হাসপাতালের ডা. অমিয় দাশ বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তিন কিশোর মারা যায়। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ছাড়া বলা যাবে না।
নিহতরা হলো, খুলনার দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১১৮৫৫৩, বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৭৫২৪ এবং একই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার তালিপপুর পূর্বপাড়ার নান্নু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), রেজিস্টেশন নম্বর ১১৯০৭। নাঈম হোসেন ধর্ষণ এবং রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল। ছেলেদের জন্য দেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলির পুলেরহাটে। এ কেন্দ্র মোট বন্দির সংখ্যা ২৮০ জন। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এ তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অবস্থার সে উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এমবিএইচ