খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ কার্তিক, ১৪৩১ | ৩১ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১১৫৪
  দ্রুতই সিটি করপোরেশন, জেলা-উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় স্থায়ীভাবে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে : স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা

শবে বরাত সংক্রান্ত ১০টি ভুল প্রচলন (ভিডিও)

মুফতি সাআদ আহমাদ

পবিত্র শবেবরাত। হাদিসের ভাষায় এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা পনেরো শাবানের রাত বলা হয়। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফার্সি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী।

উক্ত রাত্রীকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বেশ কিছু ভুল প্রচলন রয়েছে। রয়েছে কিছু বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি। কেউ কেউ এ রাত্রীতে বিশেষ পদ্ধতিতে ইবাদত বন্দেগী করা আবশ্যক মনে করেন। আবার কেউ এ রাতের স্বীকৃত ফজিলতকেও অস্বিকার করে বসেন। কারো জন্য আবার এ রাতটি খাওয়া দাওয়া আর উৎসব ছাড়া কিছুই নয়।

বক্ষমান প্রবন্ধে এমনই ১০টি ভুল ধারনার সঠিক জবাব কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে কলমবন্দি করা হয়েছে। যার ৫টি শবেবরাত সংত্রান্ত বাড়াবাড়ি এবং ৫টি ছাড়াছাড়ি সম্পর্কিত। যা আমাদেরকে শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি জানতে সহায়ক হবে। ইনশাআল্লাহ।

শবেবরাত সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ৫টি বাড়াবাড়ি

শবে বরাতের বিশেষ নামাজ
শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ পদ্ধতির নামাজের কথা লোক মুখে প্রচলিত রয়েছে। দুই বা চার রাকাত শবেবরাতের নামাজের নামে নিয়্যাত করে নিদৃষ্ট রাকাতে নিদৃষ্ট সুরা পাঠ করে এ নামাজ আদায় করা হয়। সহিহ হাদিসে এধরনের নামাজের কোন উদৃতি নেই। শবে বরাতের নামাজের নামে ইবাদাতের এই বিকৃত পদ্ধতি একটি জঘন্য বেদআত।

শবে বরাতে রাত্রী জাগরণ
ইবাদতের জন্য রাত্রী জাগরণ করা একটি মহৎ কাজ। তবে এর জন্য নিদৃষ্ট দিন-ক্ষণের বিশেষ পাবন্দি করা ঠিক নয়। এমনিভাবে শবেবরাতে রাত্রী জাগরণের নামে সারা রাত মসজিদে অবস্থান করা বা নির্ঘুম কাটানোকে পূণ্যের কাজ মনে করাও বেদআত। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা উচিত।

শবে বরাতে হালুয়া রুটি
শবে বরাত কেন্দ্র করে একটি বহুল প্রচলিত বেদআত হলো হালুয়া-রুটির বিশেষ খাবারের আয়োজন করা। বিভিন্ন ধরনের হালুয়া প্রস্তুত করা এবং মানুষকে খাওয়ানো বা বিতরণ করায় যে প্রতিযোগীতা করা হয় তা সম্পূর্ণ নিরর্থক। শরীয়াহর বিধানমতে এ মর্মে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। উপরুন্ত নানান ডিজাইনে এগুলি প্রস্তুত করা ও প্রদর্শনিতে ফজিলতপূর্ণ এই রাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য হতে মাহরুম হতে হয়।

শবেবরাতে বিশেষ আলোকসজ্জা
আলোকসজ্জা মূলোত গ্রীকদের একটি ধর্মীয় প্রথা। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে রূপ লাভ করে। হজরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, যেসব জঘন্যতম বিদয়াত ভারতবর্ষে অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, তন্মধ্যে রয়েছে (শবেবরাত প্রভৃতি উপলক্ষে) আলোকসজ্জা তথা বাসাবাড়ি, দেয়াল অট্টালিকা বৈচিত্র্যময় লাইট দ্বারা সজ্জিত করা, এর মাধ্যমে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, আগুন নিয়ে আনন্দ খেলার লক্ষ্যে দলবদ্ধ হওয়া। যেগুলোর কোনো ভিত্তি বিশুদ্ধ কিতাবগুলোতে নেই। এ ব্যাপারে কোনো দুর্বল হাদিস কিংবা কমপক্ষে একটি জাল হাদিসও পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যান্য মুসলিম এলাকায়ও এর প্রচলন নেই।

শবে বরাতে কি গোটা বছরের রিজিক নির্ধারিত হয়
অনেকের ধারণা মতে শবেবরাত মানে হচ্ছে ভাগ্যরজনী। এ রাতটি হলো এমন একটি রাত; যে রাতে আল্লাহ মানুষের এক বছরের বাজেট নির্ধারণ করেন। এক বছরের জন্য কে কী খাবে, কী করবে তা লিপিবদ্ধ করেন। সুতরাং যদি এ রাতে ভালো খাবার খাওয়া যায়, ভালো কাপড় পরা যায়, তা হলে সারা বছরই ভালো অবস্থায় দিন যাবে।

বস্তুত এমন ধারণা সম্পুর্ণ অমূলক। কুরআন সুন্নাহে এ জাতীয় কথার কোন প্রমাণ নেই। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফার্সি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এর সাথে ভাগ্যরজনী অর্থের নুন্যতম সম্পর্কও নেই। সুতরাং এ ধরনের বেহুদা চিন্তা চেতনা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

 

শবেবরাত সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ৫টি ছাড়াছাড়ি

শবে বরাত সংক্রান্ত হাদীসসমূহ বানোয়াট
অনেকেই মনে করে থাকেন যে, শবে বরাত বলতে কিছু নেই, এ রাতের ফযীলত বিষয়ে যত রেওয়ায়েত আছে সব মওযূ বা যয়ীফ। তাই শবে বরাতকে ফযীলতপূর্ণ রাত মনে করা এবং বিশেষ গুরুত্বসহকারে আমল করা জায়েয নয়।

বস্তুত এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাতের ফযীলত সর্ম্পকে একাধিক ‘মারফূ’ হাদীস ও ‘আসারে সাহাবা’ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফযীলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এ রাতের নফল নামাযের ব্যাপারে যত্নবান হতেন। আর শাবানের রোযার ব্যাপারে তো সহীহ হাদীসসমূহই রয়েছে। -ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/৬৩১-৬৩২

এছাড়া শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি (রহ.) ১৫ শাবানের রাতের ফজিলত বিষয়ক একটি হাদিস সম্পর্কে ‘সহিহ হাদিস’ বলে মন্তব্য করেছেন। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহাহ, ৩/১৩৫, হাদিস : ১১৪৪)

শবে বরাতের বিশেষ আমল
শবেবরাত একটি বিশেষত্ব এই যে, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদিগকে ব্যপক ক্ষমার ঘোষণা দেন। তবে এ রাতে নিদৃষ্ট পদ্ধতির কোন বিশেষ ইবাদতের বর্ণনা সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় না। তাই এ রাতের মাগফিরাতের আশায় নিজের সামর্থ্য মোতাবেক যেকোন নেক আমল করা যেতে পারে। এটা এক প্রকার নফল ইবাদত। আর নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে সবাই নিদৃষ্ট যায়গায় একত্রিত হয়ে তা পালনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তাই নামাজ, দোয়া, তেলওয়াত ও জিকিরসহ যেকোন ইবাদত করা হবে তা নিতান্তই নিজস্ব ভাবে আদায় করতে হবে।

শবে বরাতের বিশেষ রোজা
শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতে ইবাদত বন্দেগির পর রোজা পালন প্রসঙ্গে এক হাদিসে এসেছে- হজরত আলি ইবনে আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পনের শাবানের রাতে (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোনো রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা ডাকতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ -১৩৮৮)

সুতরাং ১৪ শাবান দিনগত রাতে সাহরী করে ১৫ শাবান রোজা রাখতে কোন দোষ নেই বরং উত্তম।

শবে বরাতে কবর জিয়ারত
এ রাতে কবর জিয়ারত করা প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি বাকির কবরস্থানে, তাঁর মাথা আকাশের দিকে তুলে আছেন। তিনি বলেন: হে আয়িশাহ! তুমি কি আশঙ্কা করেছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, তা নয়, বরং আমি ভাবলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোন স্ত্রীর কাছে গেছেন। তিনি বলেনঃ মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোকের গুনাহ মাফ করেন।

সুতরাং আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একাকি জাঁকজমকবিহীন কবর জিয়ারত করা যেতে পারে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে না জানিয়ে একাকি জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে কবর জিয়ারাত করেছিলেন। এমনকি যা তিনি হজরত আয়েশা রা. কে পর্যন্ত জানাননি।

কুরআন-সুন্নাহে শবে বরাতের ফজিলত স্বীকৃত
এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে সরাসরি কোন নির্দেশনা না থাকলেও নির্ভরযোগ্য সনদ বা বর্ণনাসূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)

হজরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত রসুল সা. বলেন, ৫টি রাত এমন আছে যখন কোন বান্দার দোয়া আল্লাহ তায়ালা ফিরিয়ে দেন না। জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শাবানের ১৫ তারিখের রাত এবং দুই ইদের রাত। (শুয়াবুল ইমান লিল বাইহাক্বী-৩/৩৪২)

(লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়ী গেট, খুলনা।)

খুলনা গেজেট/এনএম

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!