ইউক্রেনে রুশ অভিযানকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা হুমকির মধ্যে ছিল। তবে ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানির পথ খুলে দিতে গতকাল শুক্রবার রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির চুক্তির পর এ নিয়ে স্বস্তি দেখা দিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে, এ চুক্তির ফলে তা কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রধান খাদ্যদ্রব্যের জন্য এ দুই দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশে শিগগিরই খাদ্যসংকট মেটার সুযোগ নেই।
রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষ দুই গম রপ্তানিকারক দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে খাদ্যপণ্যের দাম জানুয়ারি থেকে ১৭ শতাংশ বেড়েছে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে আছে।
দুই দেশের প্রতিনিধিত্বকারী দুজন এক টেবিলে না বসে চুক্তিতে পৃথকভাবে সই করেন। বা পাশে সই করছেন ইউক্রেনের অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রী ওলেকসান্দার কুবরাকভ। তার অপর পাশে তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হালুসি আকার। আর মাঝে ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এমনকি অনুষ্ঠানে দুই দেশের পতাকাও পাশাপাশি ছিল না।
গতকাল রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, এ চুক্তির কারণে শত কোটি মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। তিনি বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমরা জাহাজ চলাচল শুরু হতে দেখব এবং অনেক দেশের মানুষই স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।’
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য, লেবানন, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া তাদের মোট আমদানির অর্ধেকই ইউক্রেন থেকে করে থাকে। ২০২১ সালে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারক দেশ মিসর তাদের গম আমদানির ৮০ ভাগই রাশিয়া ও ইউক্রেনের কাছ থেকে করেছে।
এ বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের কমডিটি মার্কেটস আউটলুকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য বাণিজ্য, উৎপাদন ও ভোগের ধরনে যে উল্লেখজনক পরিবর্তন এসেছে, তাতে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের দাম ঐতিহাসিক রকমের উচ্চ থাকবে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) দুটি সংস্থাই সতর্ক করেছে, প্রচণ্ড রকমের খাদ্য অনিরাপত্তার কারণে ২০২২ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
খাদ্য অনিরাপত্তার মধ্যে থাকা কয়েকটি আফ্রিকান দেশে মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ইরিত্রিয়ার কথা বলা যায়। গত জুনে এফএও–র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটি মোট গম আমদানির পুরোটুকুই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে করেছে। পরপর চারটি বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়াকে কেন্দ্র করে অসহায়ত্বের মধ্যে থাকা সোমালিয়ায় বেড়েছে অপুষ্টির হার। সেখানে গমের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
দেশের জনগণের ওপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ঠেকাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের ভর্তুকি বাড়াতে দেখা গেছে। মিসর সরকার প্রতি টন গম বাবদ ৪৩৫ ডলার করে ভর্তুকি দিচ্ছে। গত বছর দেশটি টনপ্রতি ২৭০ ডলার করে ভর্তুকি দিয়েছিল। উত্তর আফ্রিকার দেশটি তাদের মোট ১০ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৭ কোটির বেশি মানুষের জন্য রুটিতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। নিজেদের রিজার্ভের সুরক্ষায় ভারতসহ অন্য দেশগুলোতে বিক্রেতা খুঁজছে মিসর। গত মার্চ মাসে রুটির দাম নির্ধারণ করে দেয় দেশটি।
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচিতে (ডব্লিউএফপি) খাদ্য সরবরাহকারী শীর্ষ দেশগুলোর একটি ইউক্রেন। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় যুদ্ধ ও দারিদ্র্যকবলিত দেশগুলোতে ত্রাণ সরবরাহ করে থাকে সংস্থাটি।
কয়েক মাস ধরে ওদেসাসহ কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো আবারও খুলে দেওয়ার জন্য আহ্বান করে আসছিল ডব্লিউএফপি। ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোর জরুরি খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য এমন আহ্বান জানানো হয়। ডব্লিউএফপি বারবার সতর্ক করে আসছে যে লাখো মানুষ ঝুঁকিতে আছে।
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি ‘২০২২ সালকে নজিরবিহীন ক্ষুধার বছর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বিভিন্ন সংঘাতকে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকলে সামনের বছরগুলোতে এর প্রভাব দেখা যাবে।
এদিকে শস্য রপ্তানি নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের আভাসের পরপরই গমের দাম কমতে দেখা গেছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই গমের দাম ২ শতাংশ কমতে দেখা গেছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বিশেষজ্ঞ এবং মিসরের সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা নাদের নৌরেলদিন বলেন, ‘সামান্য ঘোষণাতে দাম কমতে দেখা গেছে।’ ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হয়ে গেলে দাম আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে তিনি মনে করেন, খাদ্যের দাম উল্লেখজনকভাবে কমার বিষয়টি জ্বালানির দামের ওপর নির্ভর করে। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত জানুয়ারি থেকে এ জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বগতি চলছে। নাদের বলেন, শস্যের দাম ও সব খাদ্যের দামের ওপর তেলের দামের বড় প্রভাব রয়েছে। কারণ, চাষাবাদ, উৎপাদন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে তেলের ব্যবহার জরুরি। সূত্র: সিএনএনের বিশ্লেষণ
খুলনা গেজেট/ এস আই