ভারত পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এই দেশের সংবিধান রচিত হয়েছে অত্যন্ত সুসংহতভাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ব্রিটেনের সংসদীয় ব্যবস্থা ও জার্মানীর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে অনুসরণ করেই ভারতীয় সংবিধান রচিত। ক্ষমতা স্বতন্ত্রকরণ নীতি বলতে আইন, বিচার ও প্রশাসনকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া। ভারতের বিচার ব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কথাটা দু:খের হলেও সত্য, ইদানীং কয়েক বছর ধরে বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। স্বশাসিত তদন্ত সংস্হাগুলিকে যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।কেন্দ্রে বা রাজ্যে যে দল ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাকে প্রটোকল মেনে চলতে হবে।
ইদানীংকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূলের মধ্যে সেই ইগোর লড়াই অনেকাংশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষত্রে একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন অপমানিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি ভারতীয় সংবিধানের মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার তার গোয়েন্দা সংস্হাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল তার গোয়েন্দা সংস্হা সিআইডিকে ব্যবহার করছে রাজ্যের বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে।
করোনা অতিমারি ও লকডাউন মুহূর্তে সব কিছুকে উপেক্ষা করেই নতুন নির্বাচিত তৃণমূল সরকারের দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় , দলের বিধায়ক মদন মিত্র ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করল সিবিআই নারদা মামলায়। তাহলে একই মামলায় অভিযুক্ত মুকুল রায় ও শুভেন্দু অধিকারীকে ছাড় দেওয়া হল কেন? তাঁরা বিজেপি করেন বলে? রাজ্যে একইভাবে তৃণমূল সরকার বিজেপির ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সি-এর বিরুদ্ধে সিআইডি লেলিয়ে দিল কেন? পারস্পরিকভাবে এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কেন? আবার এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জঘন্য রুপ সারা ভারত দেখল রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে।
কেন্দ্রীয় সরকারের জঘন্য মানসিকতা ও রাজ্য সরকারের হীন মানসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। কোনও একটা দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন দেশের সংবিধান বাদ দিয়ে কেবল দলতন্ত্রগিরি করে তা হয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক ক্ষতচিহ্ন। ইয়াস পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় টিমের পশ্চিমবঙ্গ সফরে মানুষ যা দেখলেন তাতো যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতিগুলোকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখানোর সামিল। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী গেলেন না , রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থাকার জন্য। এছাড়া আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে মুখ্যমন্ত্রীর স্তুতি পাঠ করলেন। আবার মোদীজীর মধ্যেও সেই দলীয়করণ দেখা গেল। এটা তো ভারতীয় গণতন্ত্র নয়।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়েছে। দক্ষ অফিসার হিসাবে রাজ্য সরকার তার মেয়াদ বাড়াতে পারে। কেন্দ্রীয় নির্দেশ নিতে হয় । যেসময় আলাপন বাবু ইয়াস দুর্গতদের জন্য এলাকায় ঘুরছেন, সে সময় রাজ্যসরকারের সঙ্গে পরামর্শ না করেই তাকে দিল্লিতে তুলে নিলেন, সেটাও যেমন নিন্দনীয়, তেমনি রাজ্যসরকার তাকে অবসর করিয়ে নিয়ে আবার তিন বছরের জন্য মুখ্য উপদেষ্টা করে তাকেও তো অর্থ অপচয় ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? গণতন্ত্রে যতদিন দলতন্ত্র থাকবে, ততদিন সেই গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। আজ কিন্তু ভারতে সেটাই হচ্ছে যেটা অনেকের কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয়।
খুলনা গেজেট/এনএম