সুপ্তা চাকমা থাকেন রাঙামাটি শহরের কে কে রায় সড়কে। শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিলে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন এই শিক্ষার্থী; পায়ে চোটও পান। প্রাণ বাঁচাতে এক পর্যায়ে আশ্রয় নেন বিজনী সরণির পরিচিত এক স্বজনের বাসায়। সেখানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিলেন আটকা। আতঙ্কে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালেও যেতে পারেননি। ভয়ে সেখানেই কাটান রাত। শনিবার পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে কে কে রায়ে সড়কের বাসায় ফেরেন সুপ্তা।
সুপ্তার মতো শিক্ষার্থী সেলফি চাকমাও শুক্রবার ঘটনার দিন নিজের বাসায় ফিরতে পারেননি। নিকটাত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে শনিবার সকালে বনরূপার সমতাঘাট থেকে বোটযোগে বাসায় ফেরেন। শুধু সুপ্তা কিংবা সেলফি চাকমা নন; পুরো পার্বত্যাঞ্চলের লাখো বাসিন্দার মনেই ভর করেছে এমন ভীতি।
সহিংস ঘটনায় এক দিন পরও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে থমথমে পরিস্থিতি। মানুষের আতঙ্ক কাটছে না। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল কম। শনিবার রাঙামাটির বনরূপার সাপ্তাহিক হাটও বসেনি। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। যানবাহন চলাচল করছে না। জেলা প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে। বন্ধ রয়েছে নৌযান চলাচলও। তবে নিরাপত্তার জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। বনরূপা থেকে দক্ষিণ কালিন্দীপুর পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে বিভিন্ন স্থানে রয়ে গেছে অগ্নিসংযোগের ক্ষতচিহ্ন। সাধারণ লোকজন যে যার পাড়া-মহল্লা পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সংবাদকর্মী জানান, বিক্ষোভ মিছিলের ছবি নিতে গিয়ে হামলাকারীরা তাঁকে আক্রমণের চেষ্টা করে। তখন কোনো রকম কালিন্দীপুরে গিয়ে এক বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানে নিরাপদ বোধ না করায় রাঙ্গাপানি এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। এখনও নিজের বাসায় ফেরেননি তিনি।
অভিন্ন চিত্র খাগড়াছড়িতেও। দীঘিনালা থেকে ঘটনার সূত্রপাত হলেও পুরো জেলায় ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেখানেও সাপ্তাহিক হাট বসেনি। বন্ধ রয়েছে বেশির ভাগ দোকানপাট। খুব প্রয়োজন না হলে বাসা থেকে বের হচ্ছে না মানুষ।
শুক্রবার রাঙামাটি শহরে সহিংস ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি নারী ও রাসেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী ঊষা চাকমা বলেন, সামনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান ঘিরে প্রায় ৯২ লাখ টাকার বৌদ্ধমূর্তি, রংবস্ত্রসহ বিভিন্ন ধর্মীয় জিনিসপত্র ধারদেনা করে বিক্রির জন্য কিনেছিলেন। এখন আগুনে পুড়ে নিমেষে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন কী নিয়ে বাঁচবেন? এ প্রশ্ন তাঁর। কালিন্দীপুরের ৬৫ বছরের অমিত কুমার চাকমা বলেন, শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে ঘর থেকে ভয়ে বের হননি। আতঙ্কে সারারাত ঘুমাতে পারেননি।
চলছে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, খুন, লুটপাট ও বৌদ্ধবিহার, দোকান ও ঘরবাডিতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ চলছে। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ডাকা এ অবরোধে রাঙামাটি-নানিয়ারচর-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃহত্তর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা শাখার সভাপতি তনুময় চাকমা জানান, ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষিত তিন পার্বত্য জেলায় ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে এ সড়ক অবরোধ পালিত হচ্ছে। প্রথম দিন রাঙামাটিতে কয়েক স্থানে বাধা দেওয়া ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ পালিত হয়েছে।
এদিকে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধের কারণে সাজেকে প্রায় এক হাজার পর্যটক আটকা পড়েছেন। শুক্রবার এসব পর্যটক সাজেকে বেড়াতে যান। সাজেক হিলভিউ কটেজের স্বত্বাধিকারী ইন্দ্র চাকমা জানান, সাজেকের প্রায় ২০০ গাড়ি আটকা পড়েছে। আটকে পড়া পর্যটকদের ৬০ শতাংশ রুম ভাড়া ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাঘাইছড়ি ইউএনও শিরিন আক্তার জানান, পর্যটকরা কবে নাগাদ সাজেক থেকে যেতে পারবেন বলা যাচ্ছে না। অবরোধ ও পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাদের সাজেক থেকে ছাড়া হবে।
যা বলছেন বিশিষ্টজন
চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, সহিংসতার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি যথাযথ পদক্ষেপ নিত তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও মানুষ মারা যাওয়া কিংবা সম্পত্তির এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। কারণ, কোনো একটা ঘটনা ঘটলে পাহাড়িদের ওপর হামলা ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সবার সঙ্গে বসে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত। এখানে আমরা পাহাড়ি-বাঙালি একসঙ্গে চলাফেরা করি। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। উস্কানির মাধ্যমে এ ঘটনা বড় করা হয়েছে।
জেলা জাতীয় পার্টির হারুন মাতব্বর বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস; তাই সবাইকে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে একের অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে হবে। আমরা দাবি করেছি, যাতে গুজব না ছড়ায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা সবাই সম্প্রীতি নিয়ে বাস করতে চাই। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে।
প্রসঙ্গত, মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় গণপিটুনিতে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যু ঘিরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘাতের ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত এবং উভয়পক্ষের ৫৩ জন আহত হয়। এ ঘটনায় বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর, মসজিদ, বৌদ্ধবিহারে হামলা ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
×