বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স। এরইমধ্যে ১১টি দেশে প্রায় ৮০টি কেস সনাক্ত হয়েছে এই পক্সের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, সংক্রমণ আরও বাড়তে চলেছে। মাঙ্কিপক্স সন্দেহে প্রায় ৫০টি কেস নিয়ে সংস্থাটি তদন্ত করছে। এর আগে ইটালি, সুইডেন, স্পেন, পর্তুগাল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বৃটেনে এই রোগ সনাক্ত হয়। সর্বশেষ নেদারল্যান্ড জানিয়েছে, সেখানেও একজনের মাঙ্কিপক্স নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ খবর দিয়েছে বিবিসি।
খবরে জানানো হয়, এতদিন আফ্রিকার মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে এই রোগ দেখা যেতো। এই রোগে সাধারণত কারও মৃত্যু হয় না এবং আক্রান্তের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভাল হয়ে যায়। তাছাড়া মানুষের মধ্যেও এই ভাইরাস সহজে ছড়ায় না। এখনও মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কার্যকরি কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন মাঙ্কিপক্স থেকে ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দেয় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এই দুই পক্সের ভাইরাস প্রায় একইরকম বলেও জানিয়েছেন তারা।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, তারা আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে মিলে কাজ করছে এবং এই রোগ আরও মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করতে দেশগুলোকে সাহায্য করছে। সংস্থাটির ইউরোপ মহাদেশের পরিচালক হ্যানস ক্লুগ সাবধান করে বলেন, গ্রীষ্ম মৌসুম চলছে। মানুষ এখন সমাবেশ করবে, উৎসব করবে এবং পার্টি করবে। এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। এভাবে মাঙ্কিপক্সের বিস্তার বাড়তে পারে। তাছাড়া ভ্রমণের ইতিহাস ছাড়াই মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার কথাও জানান তিনি।
বৃটেনে প্রথম এই রোগ সনাক্ত হয় ৭ই মে। আক্রান্ত ব্যাক্তি সম্প্রতি নাইজেরিয়া থেকে ফিরেছিলেন। এরপর বৃটেনে মোট ২০ জনের মাঙ্কিপক্স সনাক্ত হয়েছে। এখন এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৃটেন। দেশটি জানিয়েছে, তারা এরইমধ্যে এই ভ্যাকসিনের মজুদ শুরু করেছে এবং ঝুকিপূর্ণদের এই ভ্যাকসিন দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে স্পেনও।
মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক লক্ষণসমূহ
প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। জ্বর কমলে শরীরে দেখা দেয় ফুসকুড়ি। অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলায়।
ফুসকুড়িগুলো অত্যন্ত চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে খোস-পাঁচড়ায় পরিণত হওয়ার আগে এগুলো পরিবর্তিত হয় ও কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। পরে এগুলো পড়ে যায় এবং এসব স্থানে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হতে পারে। সাধারণত সংক্রমণ একপর্যায়ে নিজে থেকেই কেটে যায়। ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে সেরে ওঠেন রোগী।
যেভাবে সংক্রমিত হয়
কোনো সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসনালি, চোখ, নাক বা মুখের মাধ্যমে। যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে—আগে এমনটা বলা না হলেও এখন ধারণা করা হচ্ছে, যৌন মিলনের সময় সরাসরি সংস্পর্শে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। সংক্রমিত বানর, ইঁদুর ও কাঠবিড়াল এবং ভাইরাসযুক্ত বস্তু যেমন বিছানাপত্র ও জামাকাপড়ের সংস্পর্শে এলেও ছড়াতে পারে ভাইরাসটি।
কতটা বিপজ্জনক এটি
এ পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের যত ঘটনার কথা জানা গেছে, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপসর্গ মৃদু হতে দেখা গেছে। কখনো কখনো লক্ষণগুলো ছিল চিকেনপক্স বা জলবসন্তের মতো। কয়েক সপ্তাহে তা নিজে থেকেই সেরে গেছে। মাঙ্কিপক্স কখনো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। ঘটতে পারে মৃত্যুও। যেমনটা খবর পাওয়া গেছে পশ্চিম আফ্রিকায়। একজন সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসনালি, চোখ, নাক বা মুখের মাধ্যমে।
সংক্রমণ কতটা সাধারণ
এ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় একটি আবদ্ধ বানরের শরীরে। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আফ্রিকার ১০টি দেশে বিক্ষিপ্তভাবে এর সংক্রমণ ঘটতে দেখা গেছে। আফ্রিকার বাইরে প্রথম ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সে সময় রোগীরা ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছিলেন কিছু কুকুরের নিবিড় সংস্পর্শে। আর এসব কুকুরের শরীরে এ ভাইরাস ঢুকেছিল ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাধ্যমে। ওই সময় মোট ৮১ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে কারও মৃত্যু হয়নি। ২০১৭ সালে নাইজেরিয়ায় মাঙ্কিপক্স কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, সন্দেহভাজন ১৭২ জন রোগীর কথা। তাঁদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ পুরুষের বয়স ছিল ২১ থেকে ৪০ বছর।
কী চিকিৎসা
মাঙ্কিপক্সের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে গুটিবসন্তের টিকা ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে বলে প্রমাণিত। আগাম সতর্কতা হিসেবে যুক্তরাজ্য গুটিবসন্তের টিকা কিনে রেখেছে। তবে ঠিক কত টিকা সংগ্রহ করেছে, তা পরিষ্কার নয়। স্পেন কয়েক হাজার টিকা কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
কতটা উদ্বেগের
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা এখনই এ ভাইরাস দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নেই। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা (ইউকেএইচএসএ) বলছে, ঝুঁকি এখনো কম। ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের মলিকুলার ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, প্রকৃত অবস্থা হলো প্রাথমিকভাবে মাঙ্কিপক্স রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন এমন ৫০ ব্যক্তির মধ্যে মাত্র ১ জন এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এখনই দেশজুড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে আমরা আছি—এমনটা মনে করা ভুল হবে।