পায়ের তলায় ইনফেকশন। পুঁজ জমাট বেঁধে যন্ত্রণায় ছটছট করছিল ১৩ বছর বয়সী এক শিশু। অথচ তার চিকিৎসাপত্রে কোনো ওষুধ না লিখে ডাক্তার দিলেন পেটের আলট্রাসনোগ্রাম করানোর প্রেসক্রিপশন। বিতর্কিত এই ডাক্তারের বিরুদ্ধে আগেও ফাঁকা প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় একাধিক টেস্ট, একই গ্রুপের ওষুধ লিখে দেয়ার প্রমাণ আছে। বহুলালোচিত এই ডাক্তারের নাম মাহমুদা আক্তার।
তিনি যশোর জেনারেল হাসপাতালে থাকা অবস্থায় এসব অপকর্ম করার দালিলিক একাধিক প্রমাণ পেয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রত্যাহার করেছেন। গত ৫ ডিসেম্বর সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন তাকে প্রত্যাহারের এ নির্দেশ দেন। যার স্মারক নম্বর সিএসজে/এস-৮/২০১৯/৩৬৪১/৮। ডাক্তার মাহমুদা আক্তারকে সহকারী সার্জন পদে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে চাঁচড়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এখন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটের সাত নম্বর কক্ষে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করবে কচুয়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সহকারী সার্জন শারমিন সুলতানা। রোববার থেকে এ আদেশ কার্যকর হয়েছে। পায়ের তোলায় ফোঁড়ার চিকিৎসার জন্য পহেলা ডিসেম্বর যশোর সদর উপজেলার বালিয়া ভেকুটিয়া গ্রামের ১৩ বছর বয়সী শিশু আবদুল্লাহকে হাসপাতালের সাত নম্বর কক্ষে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। ডাক্তার মাহমুদা আক্তার রোগীর ফাঁকা ব্যবস্থাপত্রে পেটের আলট্রাসনোগ্রাম, আরবিএস, লিপিট প্রোফাইল লিখে টেস্ট করিয়ে আনতে বলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর চাঁচড়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সহকারী সার্জন মাহমুদা আক্তারকে যশোর হাসপাতালে সাময়িক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালের বহির্বিভাগে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
একাধিক অভিযোগে জানা গেছে, যশোর হাসপাতালে সংযুক্ত হওয়ার পরেই তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করেন। তার দুর্ব্যবহারের শিকার হতে থাকেন ডাক্তার, সেবিকা, ওয়ার্ডবয়, আয়া, রোগী ও তাদের স্বজনরা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের সহায়তায় ডাক্তার মাহমুদা আক্তার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাসপাতালে আসা রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে বাধ্য করেন। গত শনিবার হাসপাতালের বহির্বিভাগে সাত নম্বর কক্ষে জ্ব¡রের চিকিৎসা নিতে আসা ৫০ বছর বয়সি বাবুল জানান, সাত নম্বর কক্ষে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মাহমুদা আক্তার তার ব্যবস্থাপত্রে কোনো ওষুধ না লিখে পাঁচটি পরীক্ষা করানোর একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে হাসপাতালের সামনের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষাগুলো করিয়ে আনতে বলেন। ওই রোগী সেখান থেকে তিনি ১৬শ’ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করান। এরপর তিনি তাকে ব্যবস্থাপত্র দেন। ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে তাকে দেয়া রিপোর্টগুলোর উপরে লেখা রয়েছে ‘রেফারেন্স বাই ডাক্তার মাহমুদা আক্তার।’
কথা হয় কাশিমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের ৪২ বছর বয়সী বরুণ চন্দ্র হালদারের সাথে। তিনি জানান, কয়েকদিন আগে সামান্য গায়ে ব্যথার চিকিৎসা নিতে তিনি হাসপাতালে যান। ওইদিন ডাক্তার মাহমুদা আক্তার ব্যবস্থাপত্রে কোনো প্রকার ওষুধ না দিয়েই আলট্রাসনোগ্রামসহ সাতটি টেস্ট করাতে বলেন বাইরে থেকে। এ সময় তিনি ডাক্তারের কাছে জানতে চান, তার শরীরে ব্যথা, কিন্তু আলট্রাসনোগ্রাম কেন করাতে হবে। জবাবে ডাক্তার বলেন, ‘আপনি ডাক্তারের থেকে বেশি বুঝলে আমার চেয়ার বসেন। না হয় বাড়ি গিয়ে নিজের চিকিৎসা নিজে করান। হাসপাতালে যখন এসেছেন ডাক্তারের কথা মতো কাজ করতে হবে।’ পরে তিনি বাধ্য হয়ে ডাক্তারের পছন্দের ক্লিনিক থেকে পরীক্ষাগুলো করাতে তার সাড়ে তিন হাজার টাকা গুণতে হয়। কেবল বরুণ চন্দ্র হালদার না, তার মতো একাধিক রোগীর সাথে খারাপ আচরণ করে আসছিলেন ডাক্তার মাহমুদা আক্তার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাত নম্বর কক্ষে চিকিৎসা নিতে গেলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের প্রয়োজন ছাড়াই রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রেসহ আট থেকে ১০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে ধরিয়ে দেয়া হতো লিখিত কাগজ। এমনকি তিনি বলে দিতেন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এই পরীক্ষাগুলো করাতে হবে। এ কারণে রোগীরা ডাক্তারের নির্দেশিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হন। এ সুযোগে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকপক্ষ রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। অপরদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাসপাতালে আসা দরিদ্র রোগীরা।
এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক দিলীপ কুমার রায় জানান, সিভিল সার্জন অফিস থেকে রোবাবার তিনি একটি পত্র পেয়েছেন। ওই পত্রের আলোকে ডাক্তার মাহমুদা আক্তারকে তার পূর্বের কর্মস্থলে পাঠানো হয়েছে।
খুলনা গেজেট / এমএম