যশোরের ব্যাংকিং সেক্টরে এখনো এলোমেলো অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যাংক ও এটিএম বুধে পর্যাপ্ত টাকা পাচ্ছে না গ্রাহকরা। এ কারণে ব্যবসায়ীদের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যদিও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও স্বাভাবিক নয়। যে কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে গত দেড় সপ্তাহ ব্যাংকগুলো এটিএমসেবা কমিয়ে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের হিড়িক পড়বে এমন ধারনা করেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। যদিও তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, যশোরের ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা বেশি হচ্ছে ও পর্যাপ্ত টাকা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তবে টাকার অপব্যবহার পাচার রোধসহ আরো কয়েকটি ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী যশোরের ব্যাংকগুলো একদিনে গ্রাহককে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকার বেশি সরবরাহ না করায় বিপাকে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। যাদের প্রতিদিন ব্যবসায়ীক কাজে ৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনদেন করতে হয়, এমন ব্যবসায়ীও রয়েছেন যশোরে। ব্যাংকের এ নতুন কর্মকান্ডে তারা বিপাকে পড়েছেন।
সূত্র জানায়, গত ১০ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো এক জরুরি বার্তায় নির্দেশনা দেয়া হয়, নগদ পরিবহনের নিরাপত্তা সমস্যার কারণে আগামি সপ্তাহে ২ লাখের বেশি নগদ অর্থ তোলা যাবে না। পাশাপাশি চেকে লেনদেনের ক্ষেত্রেও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একইসাথে যে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন বন্ধ করতে ব্যাংকগুলোকে সচেষ্ট হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
সোনালী ব্যাংক যশোর কর্পোরেট শাখা সূত্র জানায়, সরকার পরিবর্তনের পর নগদ টাকা উত্তোলনের চাপ কিছুটা বেড়ে যায়। এসব অর্থ যাতে কোনোভাবেই অবৈধ কাজে ব্যবহৃত না হয়, সে জন্য নগদ টাকা উত্তোলন কিছুটা নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে ১ লাখ টাকার বেশি এবং চলতি সপ্তাহে ২ লাখ টাকার বেশি উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সেই নির্দেশনা মেনেই যশোরে ব্যাংকিং সেক্টর পরিচালিত হচ্ছে।
এ নিদের্শনায় সমস্যায় পড়েছেন যশোরের ব্যবসায়ীরা। তারা বড় অঙ্কের চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ১৩ আগস্ট যশোর সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখায় আসা চাঁচড়ার মৎস্য ব্যবসায়ী তারেক রহমান জানিয়েছেন, তার ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার উপরে জমা রয়েছে। ব্যবসায়ীক লেনদেনে তার টাকা জরুরি প্রয়োজন। অথচ ব্যাংক থেকে তাকে বলা হচ্ছে আজ দুই লাখের বেশি টাকার চেক দিলে টাকা তোলা যাবে না। আর চলতি সপ্তাহ ধরেই সর্বোচ্চ দুই লাখ করেই টাকা তুলতে হবে। এই ব্যাংকিং জটিলতা ও প্রক্রিয়ায় তিনি ব্যবসায়ীকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একই কথা বলেন অগ্রণী ব্যাংকে আসা গ্রাহক কিসমত নওয়াপাড়ার সোহরাব হোসেন। তিনি ঝুটের ব্যবসা করেন। তিনি জানান, দেশে স্বভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় এখন তার টাকার প্রয়োজন। ব্যাংক থেকে দুই লাখের বেশি ছাড় দিচ্ছে না। যে কারণে তিনি সমস্যায় পড়ছেন।
এদিকে, রোহিতার আফজাল হোসেন, পুলেরহাটের আব্দুল গফ্ফার, হাশিমপুরের কিশোর কুমারসহ অনেকেই বলেছেন, বিগত দেড় সপ্তাহ জুড়ে গ্রামাঞ্চলের এটিএম বুথগুলো থেকে টাকা মিলছে না। ফলে বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ বুথ কার্যত অচল। আবার অনেক বুথে মেশিন সচল থাকলেও প্রত্যাশিত টাকা মিলছে না। এ পরিস্থিতিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেক গ্রাহক। হাতের কাছে এটিএম বুথ থাকলেও গ্রাহকরা দিনের পর দিন ব্যাংকিং সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। স্বাভাবিক কেনাকাটা ব্যবসা বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়ছে। দ্রুত এটিএম বুথের ব্যাংকিং কার্যকর করার দাবি জানান তারা।
এটিএম সেবায় এ সংকট তৈরি হওয়ায় যশোরের ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, দ্রুত এ সংকট কেটে যাবে। গ্রাহকরা আগের মতই সেবা পাবেন। কয়েকদিন ধরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার আশঙ্কায় এটিএম বুথে টাকা পাঠানো যাচ্ছে না বলে এ সংকট তৈরি হয়েছে।
সাউথইস্ট ব্যাংক যশোর শাখার প্রধান ও ব্যাংকের সিনিয়র সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট একেএম আসাদুজ্জামান সোহাগ বলেন, কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের উপস্থিতি কিছুটা বেড়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার চাপও কমে এসেছে।
তবে ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতে টাকা রিফিল করতে এখনো সমস্যায় রয়েছে। শাখা ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা জমা আছে। কারো চেক ফেরত যাচ্ছে না। তবে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা অনুযায়ী দুই লাখের বেশি কাউকে উত্তোলন করতে দেয়া হচ্ছে না। কোনো ব্যবসায়ী যৌক্তিক ব্যাখা দিলে তাকে বেশি টাকাও দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে।
ডাচবাংলা ব্যাংক যশোরের ব্যবস্থাপক দিবাকর বিট বলেন, তার ব্যাংকে এখন লেনদেন স্বাভাবিক চলছে। নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির কারণে গ্রামাঞ্চলের এটিএম বুথে টাকা পৌঁছানো যায়নি। শহরের ৮টি বুথে টাকা রয়েছে, গ্রাহকরা টাকাও তুলতে পারছেন। আর গ্রামাঞ্চলের ৫টি বুথে টাকা পাঠানো হচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে এ সেবা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এটিএম বুথে টাকার সংকট আজকালের মধ্যে দুর হবে। তার ব্যাংকে এখন স্বাভাবিক লেনদেন চলছে।
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক যশোর কর্পোরেট শাখার উপ মহাব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রোববার থেকে প্রথম কার্যদিবসে ব্যাংক কার্যক্রম শুরু হলেও, পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। মাঠ পর্যায়ে পুলিশ এখনও কার্যকরভাবে মাঠে নামেনি। যে কারণে ব্যাংকের গ্রামাঞ্চলের এটিএম বুথগুলো কার্যত এখনও পরিপূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে আসেনি। সোনালী ব্যাংকের যশোর শহরের ৩টি বুথ সচল রয়েছে এবং সেখানে টাকা উত্তোলন স্বাভাবিক রয়েছে। আর গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকের ৭টি বুথে টাকা সরবরাহ করা যায়নি। পরিস্থিতির উত্তোরণ হচ্ছে। কাজেই আজকালের মধ্যেই ওই ৭টি বুথেও টাকা যাবে, গ্রাহকরা বুথ সুবিধা পাবেন।
তিনি বলেন, পরিস্থিতিগত কারণে ব্যাংক কয়েকদিন বন্ধ ছিল। আবার ব্যাংক সচল হলেও মানুষের উপস্থিতি কম ছিল। এখন গ্রাহকদের উপস্থিতি কিছুটা বেড়েছে। তবে টাকা তুলে নেয়ার কোনো হিড়িক পড়েনি। বরং টাকা জমা পড়েছে বেশি। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই লাখের বেশি টাকা এ সপ্তাহে দেয়া যাচ্ছে না। এতে করে ব্যবসায়ীরা সাময়িক সমস্যায় পড়ছেন ঠিকই। তবে অচিরেই তা ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আশা করেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন ব্যাংকিং কার্যক্রম আরো নির্বিঘœ হবে এবং লেনদেন আরো স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে।
খুলনা গেজেট/কেডি