খুলনা, বাংলাদেশ | ২৪ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৯ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  ড. শেখ আব্দুল রশিদকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে ২ বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ
  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯৮১
  ছয় মামলায় সাবের হোসেনের জামিন, কারামুক্তিতে বাধা নেই
  বাংলাদেশী ৫ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরকান আর্মি

যশোরের মাতৃসেবা ক্লিনিক তৃতীয় দফায় বন্ধ করলো স্বাস্থ্য বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

যশোরের আলোচিত মাতৃসেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগোনস্টিক সেন্টার তৃতীয় দফায় বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। বুধবার সিভিল সার্জন বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন। এসময় তিনি নানা অনিয়ম হাতেনাতে ধরেছেন।

যশোর শহরের ঘোপ জেল রোডের একটি ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয়তলায় আগে ছিলো নূর মহল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগোনস্টিক সেন্টার। নানা অনিয়মের কারণে স্বাস্থ্য বিভাগ অভিযান চালিয়ে এটি বন্ধ করে দেয়। এর কিছুদিন পর ক্লিনিক মালিক ডাক্তার মোজাম্মেল হক শুধুমাত্র সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন মাতৃসেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগোনস্টিক সেন্টার। এখানে ডাক্তার, আয়া-কর্মচারী সবাই একই ছিল, শুধু বদলে ছিলেন সাইনবোর্ড। চতুর ডাক্তার মোজাম্মেল শুধুমাত্র নতুন ওই নামে ক্লিনিকের আবেদন করে চালিয়ে যাচ্ছিলেন একের পর এক অবৈধ কর্মকান্ড। যাতে গিনিপিগের ন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও মৃত্যুবরণ করছিলেন সাধারণ মানুষ।

ক্লিনিকের দীর্ঘদিনেও ছিল না লাইসেন্স, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, দক্ষ সেবিকা, প্যাথলজিস্ট ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা। শুধুমাত্র এমবিবিএম পাশ ডাক্তার মোজাম্মেল হক সকল রোগের বিশেষজ্ঞ সেজে অসুস্থ রোগীর অস্ত্রপোচার করছিলেন। আর কথিত সেবিকা পিঞ্জিরা চিকিৎসক সেজে রোগীকে অজ্ঞান করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সর্বশেষ এ ক্লিনিকে ১০ জানুয়ারি আসমা বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধূর অপচিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে।

যশোর সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানিয়েছে, ঘোপ জেল রোডে নূরমহল ক্লিনিক স্থাপন ও অনুমোদন পাওয়ার পর মালিক পক্ষ স্বাস্থ্য নীতিমালা উপেক্ষা করে আসছিলেন। সেখানে রোগীর অস্ত্রোপচার, অজ্ঞান করা, নানা রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করতেন সর্ব রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোজাম্মেল হক। এমবিবিএস পাশ করা এই চিকিৎসক সেখানে রোগীদের আল্ট্রাসনোগ্রামও করতেন।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে এ ক্লিনিকে ডাক্তার মোজাম্মেল হকের ভুল অস্ত্রোপচারে এক নারী মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় সিভিল সার্জনের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কমিটির প্রধান ছিলেন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার এমদাদুল হক রাজু। কমিটি ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু ও সেখান নানা অনিয়মের সত্যতা পান। তদন্ত প্রতিবেদনে নূর মহল ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল ও রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। একই বছরের ২ নভেম্বর নূর মহলের লাইসেন্স বাতিলের পত্র আসে সিভিল সার্জন অফিসে। পরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এর মাস দু’য়েক পর তিনি একইস্থানে প্রতিষ্ঠা করেন মাতৃসেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখানেও সমানে চলতে থাকে অনিয়ম ও দুর্নীতি।

২০২০ সালের ১২ নভেম্বর যশোরের নির্বাহী ম্যাজিস্টেট মাহামুদুল হাসানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়মের কারণে মাতৃসেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করেন। এসময় মালিক ডাক্তার মোজাম্মেল হককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। এর আগে অক্টোবর মাসে লাইসেন্সবিহীন মাতৃসেবা ক্লিনিকে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এসময় ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহারের প্যাডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র আগুনে পুড়ানোর পর মাতৃসেবা ক্লিনিকের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য বিভাগ।

সবশেষ গত ৮ জানুয়ারি ঝিকরগাছা উপজেলার বামনআলী চাপাতলা গ্রামের গোলাম রসুলের স্ত্রী আসমা বেগম (৩২) অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের জন্য ভর্তি হন বিতর্কিত ওই ক্লিনিকে। ডাক্তার রোগীর বিবরণ শুনে স্বজনদের জানান অপারেশন করতে হবে। পরে ৯ জানুয়ারি সকালে ডাক্তার মোজাম্মেল অজ্ঞানের ডাক্তার ছাড়াই নিজে রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করেন। এর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পর রোগীর জ্ঞান ফিরলে ব্যাথায় চিৎকার করে ওঠেন। রোগীর স্বজনরা বিষয়টি ওয়ার্ডের সেবিকাদের জানালে ডাক্তার আবারও অজ্ঞানের ইনজেকশন দেন। এরপরে রোগীর আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে ডাক্তার মোজাম্মেল দ্রুত রোগীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানে আইসিইউতে নিয়েও চিকিৎসকরা আসমার জ্ঞান ফেরাতে পারেননি। এখানে গত ১০ জানুয়ারি আসমার মৃত্যু হয়।

এ জাতীয় তথ্যের ভিত্তিতে যশোরের নবাগত সিভিল সার্জন ডাক্তার বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস আলোচিত মাতৃসেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালান। এসময় তিনি নানা অনিয়ম হাতেনাতে ধরার পর ক্লিনিকটি বন্ধ করার ঘোষণা দেন। এ সংক্রান্ত চিঠি বৃহস্পতিবার ক্লিনিকে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানের সকল অনিয়ম দূর করতে হবে। নিয়মানুযায়ী পর্যাপ্ত নার্স ও ডাক্তার থাকতে হবে। অপারেশন থিয়েটারে অজ্ঞানের ডাক্তারসহ সকল অসঙ্গতি দূর না করা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি খেলা যাবে না, বন্ধ রাখতে হবে। এ নির্দেশের ব্যত্যয় হলে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে ক্লিনিকের মালিক ডাক্তার মোজাম্মেল হক জানান, তিনি নিয়মনীতি মেনেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। তার ক্লিনিকে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। আসমা বেগম খুলনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডাক্তার বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, মাতৃসেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করে তিনি নানা অনিয়ম হাতেনাতে ধরেছেন। এ কারণে তিনি ক্লিনিকটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে সকল অনিয়ম বন্ধ ও নিয়মানুযায়ী ডাক্তার, ডিপ্লোমাধারী নার্স নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত ক্লিনিকটি বন্ধ রাখা হবে বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, যশোরের অনিয়মতান্ত্রিক স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হচ্ছে। দ্রুত এ সব প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের ক্লিনিকগুলোতেও স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!