খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের করণীয় (পর্বঃ ৭)

হাফেজ মাওলানা মুফতি জুবায়ের হাসান

জানাযা বহন করা ও তার ফজিলত

• হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাযার সাথে চলার অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
একটি হাদীসে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنِ اتَّبَعَ جَنَازَةَ مُسْلِمٍ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، وَكَانَ مَعَهُ حَتَّى يُصَلِّى عَلَيْهَا وَيَفْرُغَ مِنْ دَفْنِهَا، فَإِنَّهُ يَرْجِعُ مِنَ الْأَجْرِ بِقِيرَاطَيْنِ، كُلُّ قِيرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ثُمَّ رَجَعَ قَبْلَ أَنْ تُدْفَنَ، فَإِنَّهُ يَرْجِعُ بِقِيرَاطٍ
অর্থ: যে ব্যক্তি জানাযার সঙ্গে জানাযার নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকে সে একটি কিরাত সওয়াবের অধিকারী হবে। আর যে ব্যক্তি দাফন করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে সে দুই কিরাত সওয়াবের অধিকারী হবে। কোন এক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল! এই দুই কিরাত কী রকম হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন এই কিরাত দুটি, দুটি উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ হবে। সর্বাবস্থায় জানাযার নামায পড়া এবং দাফন করা পর্যন্ত জানাযার সঙ্গে শরীক থাকা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।

জানাযার সঙ্গে অংশগ্রহণ করা বা জানাযার পেছনে যাওয়ার আমল এমন, যা আমরা সবাই কমবেশি করে থাকি। সম্ভবত এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যে কখনো জানাযায় অংশগ্রহণ করেনি। বরং সবাই কোনো না কোনো সময় এ কাজে অংশগ্রহণ করেছে।

কিন্তু সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে এ আমল একটি প্রথায় পরিণত হতে চলেছে। যেমন: কিছু লোকের জানাযায় অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্য হলো এই যে, যদি জানাযায় অংশগ্রহণ না করে তাহলে সমাজ অসন্তুষ্ট ও মনোক্ষুণ হয়ে যাবে। এই নিয়ত এবং উদ্দেশ্য ভুল। এ জন্য জানাযায় অংশগ্রহণের সময় নিজের নিয়্যাত সঠিক করে নেওয়া চাই। এই নিয়ত করা যে – আমি ওই মুসলমানের হক আদায় করার জন্য অংশগ্রহণ করব, আর জানাযায় অংশগ্রহণ করা তো হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত এবং তার আদেশ, এ জন্য আমি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে জানাযায় অংশগ্রহণ করব- এই নিয়তে যখন অংশগ্রহণ করবে তখন এই আমল অনেক বড় সওয়াবের উসিলা হয়ে যাবে।

• মায়্যেতের খাটিয়া বহনের সময় অধিকাংশ এলাকায় উচ্চস্বরে কালিমা পড়তে দেখা যায়। এটি একটি ভুল রসম।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম জানাযা বহনের সময় চুপ থাকতেন। আখেরাতের বিষয়ে চিন্তামগ্ন থাকতেন। ইবনু জুরাইজ রাহ. বলেন-
أَنَّ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا تَبِعَ الْجِنَازَةَ أَكْثَرَ السَّكُانَ، وَأَكْثَرَ
حَدِيثَ نَفْسِهِ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জানাযার পিছনে চলতেন তখন অধিক চুপ থাকতেন এবং চিন্তায় পূর্ণ মগ্ন থাকতেন। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬২৮২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৩১৫
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا تُتْبَعُ الْجَنَازَةُ بِصَوْتٍ، وَلَا نَارٍ
জানাযার পিছনে যেন শব্দ না করা হয় এবং আগুন না নেওয়া হয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৫১৫

সুনানে কুবরা বায়হাকী ও ইবনুল মুনযিরের আলআওসাতের এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, সাহাবায়ে কেরামের আমল ব্যাপকভাবে এমনি ছিল; তাঁরা জানাযার পিছনে যাওয়ার সময় কোনো আওয়াজ করতেন না। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/৭৪; আলআওসাত, ইবনুল মুনযির ৫/৪২২ (৩০৩৪)

এ সমস্ত হাদীস ও আছারের আলোকে ফকীহগণ বলেছেন, জানাযার পিছনে চলার সময় মূল কাজ হল আখেরাতের ফিকিরে থাকা। যিকির করতে চাইলে তা হবে অনুচ্চস্বরে। এক্ষেত্রে যিকির করতে গিয়ে আওয়াজ উঁচু করা ঠিক নয়। -বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৬; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৩৭

• আরও একটি আদব হলো এই, যখন জানাযা নিয়ে যেতে থাকবে তখন জানাযা সামনে থাকা চাই, এবং লোকেরা তার পিছনে পিছনে চলবে। ডানে, বামে চলাও সঠিক। কিন্তু জানাযার আগে চলা ঠিক নয় বরং আদবের খেলাফ। অবশ্য কাঁধে বহন করার উদ্দেশ্যে সামান্য সময়ের জন্য জানাযার সম্মুখে চলে গেলে এতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু জানাযা কাঁধে নেয়ার জন্য কিছু লোক জানাযার সামনে দূর দূরান্ত পর্যন্ত এমন লম্বা সারি তৈরি করে যাতে জানাযার সঙ্গে চলার সকল লোক জানাযার সামনে চলে যায় আর জানাযা পিছে পড়ে যায়। এই পদ্ধতি সঠিক নয়।
• জানাযাকে কাঁধে নেয়ার পদ্ধতি হলো এই যে, সর্ব প্রথম মাইয়্যেতের ডান হাতের দিকের পায়া নিজের ডান কাঁধের উপর নিবে এবং কমপক্ষে দশ কদম চলবে। এটাই উত্তম, যদি দশ কদম চলার শক্তি থাকে। এই কারণে অন্য লোকদের এমন তাড়াহুড়া করা উচিত নয় যে, একজন জানাযা কাঁধে নিয়ে দাড়ানো মাত্রই দ্বিতীয় ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ সামনে অগ্রসর হয়ে তার নিকট থেকে জানাযা নিয়ে নিবে, এমনটি করা উচিত নয়। আর যদি কোনো ব্যক্তি শক্তিহীন, দূর্বল ও অসুস্থ হয় যে, দশ কদম খাটিয়া কাঁধে রাখাও তার জন্য কষ্টকর হয়, তাহলে তখন অন্য লোকদের উচিত তার থেকে তাড়াতাড়ি খাটিয়া নিয়ে নেয়া যেন তার কষ্ট না হয়। অতপরঃ মাইয়্যেতের ডান পায়ের দিকের পায়া নিজের ডান কাঁধের উপর উঠাবে এবং দশ কদম যাবে। এরপর মাইয়্যেতের বাম হাতের দিকের পায়া নিজের বাম কাঁধের উপর উঠাবে এবং দশ কদম যাবে। তারপর মাইয়্যেতের বাম পায়ের দিকের পায়া নিজের বাম কাঁধের উপর উঠাবে এবং দশ কদম যাবে। প্রত্যেক ব্যক্তিই জানাযার চারটি পায়াই বহন করতে কাঁধ দিবে এবং চল্লিশ কদম যাবে। এই পদ্ধতি সুন্নাতের অধিক নিকটবর্তী এবং উত্তম। যদিও তার পরিপন্থি করাও নাজায়েয নয়।
-আদ্দুররুল মুখতার ৩/১৩৫

আজকাল জানাযা নিয়ে যাওয়ার সময় লোকেরা পরস্পরে ধাক্কা পাল্টা ধাক্কা দিতে থাকে। কাঁধ দেয়ার আগ্রহে যদি অন্য মুসলমান ভাইকে ধাক্কা দেয়া হয়, এই বিষয়ের প্রতি আমাদের কারো খেয়াল থাকে না যে, আমরা মুসলমানদের কষ্ট দিয়ে হারাম কাজে লিপ্ত রয়েছি। কাঁধ দেয়ার সওয়াব নষ্ট করে উল্টা গুনাহ অর্জন করছি। এ জন্য এমনটি করা উচিত নয়। বরং ধীরস্থিরভাবে কাঁধ দেয়া চাই এবং অন্যকেও সুযোগ দেয়া চাই যেন, অন্য মুসলমান ভাই কাঁধে নিয়ে দশ কদম পূর্ণ করতে পারে। এর পরে চাইলে তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া যেতে পারে।
হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীসের মধ্যে জানাযাকে নিয়ে যাওয়ার এই আদব এরশাদ করেন যে,
أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ، فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرُ تُقَدِّمُونَهَا، وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ ، فَشَرٌّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ
অর্থঃ যখন তোমরা জানাযা নিয়ে যাও তখন সামান্য দ্রুত পদক্ষেপে অগ্রসর হও, আস্তে চলো না এবং এর কারণও বর্ণনা করেন যে, সে যদি জান্নাতি হয় তাহলে তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কেন দেরী করছো? তাকে তাড়াতাড়ি তার উত্তম ঠিকানায় পৌঁছে দাও। আর যদি সে দোযখী হয়- আল্লাহ মাফ করুন- তাহলে দোযখের উপযুক্তকে তাড়াতাড়ি তার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে নিজের কাঁধ থেকে ওই বোঝা দুর করে দাও। আবার এতটা দ্রুত করা উচিত নয়, যার কারণে জানাযা খাটিয়ায় নড়াচড়া করতে থাকে বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে চলো এবং তাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও।
-সহীহ বুখারী, হাদিসঃ ১৩১৫; আলবাহরুর রায়েক ২/৩৩৫

• এমনিভাবে একটি আদব ও সুন্নাত হলো এই যে, কবরস্থানে যতক্ষণ পর্যন্ত লাশ কাঁধ থেকে নামিয়ে নিচে রেখে দেয়া না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত যেন কোনো লোক না বসে বরং দাঁড়িয়ে থাকবে। আর যখন লাশ মাটিতে রাখা হবে তখন বসতে পারবে। হ্যাঁ, যদি কোনো ব্যক্তি অসুস্থ বা দূর্বল হয় সে বসলে তাতে কোনো অসুবিধে নেই। অতএব সমস্ত আমল বা কাজে সুন্নাত এর অনুসরণ এর নিয়তে করবে এবং উহার এহতেমাম করবে। তাহলে সর্বাবস্থায় কৃত কাজ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
-বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৬

• মহিলাদের জন্য জানাযার সাথে অথবা পিছন পিছন চলা মাকরূহ তাহরীমি। অর্থাৎ নাজায়েয।
• যে সকল লোকজন জানাযার সাথে নেই। বরং রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করছে বা অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে কেউ যদি উপবিষ্ট অবস্থায় থাকে, তাহলে এমন লোক জানাযা দেখে তাযীম বা সম্মানার্থে দাঁড়াবে না, বরং বসে থাকবে। -ফাতহুল কাদীর ২/১৪২

লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!