মুসলিম ব্যক্তি নিজের ওপর অপর মুসলিম ভাইয়ের অধিকারসমূহ আদায় ও আদবসমূহ মেনে চলার আবশ্যকতার ব্যাপারে বিশ্বাস করে; সুতরাং সে তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে এবং তার অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে দিবে; আর সে এটাও বিশ্বাস করে যে, এসব আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত এবং এর দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা যায়; কেননা, এসব অধিকার ও আদব আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম ব্যক্তির ওপর বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, যাতে সে তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে এগুলো মেনে চলে; সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই— তার এ কাজ করাটা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নৈকট্য অর্জনের উপায় বলে গণ্য হবে।
আর এসব আদব ও অধিকারের অন্যতম কিছু দিক নিম্নরূপ:
১. যখন তার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হবে, তখন কথা বলার পূর্বেই তাকে সালাম প্রদান করবে; সুতরাং সে বলবে: আসসালামু আলাইকুম, তারপর সে তার সাথে মুসাফাহা করবে এবং সালামের জবাব স্বরূপ বলবে: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: আর তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তমভাবে প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা সেটারই অনুরূপ করবে। -সূরা নিসা, আয়াতঃ ৮৬
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ فَتَصَافَحَا، وَحَمِدَا اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ، وَاسْتَغْفَرَاهُ غُفِرَ لَهُمَا
যখনই দুইজন মুসলিম ব্যক্তি পরস্পর সাক্ষাৎ হওয়ার পর মুসাফাহা করে এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ও ক্ষমা চায়, তারা পরস্পর থেকে আলাদা হওয়ার আগেই তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। -আবু দাউদ, হাদীস নং- ৫২১১
২. যখন সে হাঁচি দিবে, তখন তার হাঁচির জবাব দিবে; অর্থাৎ সে যখন হাঁচি দেওয়ার পর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবে, তখন সে তাকে উদ্দেশ্য করে বলবে: ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন); আর তখন হাঁচিদাতা তার জবাব স্বরূপ আবার বলবে: ‘ইয়াহদী কুমুল্লাহ ওয়া ইউসলিহু বালাকুম’ (আল্লাহ তোমাদেরকে হিদায়েত করুন এবং তোমাদের অবস্থাকে ভালো করে দিন)। -সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭০
৩. যখন সে অসুস্থ হবে, তখন তার সেবা-যত্ন করা এবং তার জন্য রোগমুক্তির দুআ করা। -বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭৮
হযরত আয়িশা রা. বলেন: নবী করীম ﷺ নিজের পরিবারের কোনো রোগীকে দেখতে গেলে তার উপর ডান হাত বুলাতেন এবং বলতেন:
اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ ، أذْهِب البَأسَ ، اشْفِ أنْتَ الشَّافِي لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفاؤكَ ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقماً
(হে আল্লাহ! হে মানুষের রব! রোগ দূর কর, রোগমুক্তি দাও, তুমিই রোগমুক্তি দানকারী, কোনো রোগমুক্তি নেই তোমার রোগমুক্তি ছাড়া— যা কোনো রোগকে ছাড়ে না)। -সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৫৪১১
৪. সে যখন ইন্তেকাল করবে, তখন তার জানাযায় হাযির হওয়া; কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের পাঁচটি হক বা অধিকার রয়েছে: সালামের উত্তর দেয়া, রোগীর সেবা করা, জানাযার নামাযে অংশ নেয়া, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচির জবাব দেয়া। -বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭৮
৫. তাকে (ভালো) উপদেশ দেওয়া, যখন সে কোনো বিষয় বা ব্যাপারে উপদেশ বা পরামর্শ চায়; অর্থাৎ সে কোনো বিষয় বা ব্যাপারে যা উত্তম ও সঠিক মনে করবে, তা তাকে বলে দেবে। নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, তার জন্যও তা পছন্দ করা এবং নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে, তার জন্যও তা অপছন্দ করা। যেখানেই তার সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার দরকার, সেখানেই তাকে সাহায্য করা এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন না করা।
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মান-সম্মান নষ্ট করা থেকে নিজে বিরত থাকবে বা কাউকে বিরত রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবেন। -তিরমিযী, হাদিস নং- ১৯৩১
৬. তাকে কোনো মন্দ কিছুর দ্বারা আক্রমণ না করা অথবা তাকে কোনো অপছন্দনীয় বিষয়ের সাথে না জড়ানো বরং তার সাথে বিনয়ী হওয়া এবং তার উপর অহঙ্কার প্রদর্শন না করা; আর নিজে বসার জন্য তাকে তার বৈধ বসার স্থান থেকে উঠিয়ে না দেওয়া। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট অহী পাঠিয়েছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও, যাতে কেউ কারও উপর অহঙ্কার প্রকাশ না করে।
৭. তার সাথে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে না রাখা। হাদীসে এসেছে কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলিম ভাইকে তিন দিনের বেশি বিচ্ছিন্ন করে রাখা বৈধ নয়; তাদের উভয়ের মাঝে সাক্ষাৎ হয়, তখন একজন এ দিকে এড়িয়ে যায়, আরেকজন ঐ দিকে এড়িয়ে যায়; এমতাবস্থায় তাদের উভয়ের মধ্যে যে আগে সালাম দিবে, সে-ই উত্তম বলে বিবেচিত হবে। -বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৮৩
৮. তার গীবত না করা, তাকে হেয় প্রতিপন্ন না করা, তার দোষ বর্ণনা না করা, অথবা তাকে উপহাস না করা, তাকে বিকৃত নামে না ডাকা, অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য তার কোনো কথা ফাঁস না করা। -সূরা হুজুরাত, আয়াতঃ ১১-১২
৯. অন্যায়ভাবে তাকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় গালি না দেওয়া; কেননা, মুসলিম ব্যক্তিকে গালি দেওয়া গোনাহ এবং তার বিরুদ্ধে অন্যায় ভাবে লড়াই করা কুফরী। আর কোনো ব্যক্তি যেন অপর কোনো ব্যক্তিকে ফাসেক অথবা কাফির না বলে; কারণ, সে ব্যক্তি যদি প্রকৃতই তা না হয়ে থাকে, তাহলে এ অপবাদ তার নিজের ওপর এসে পড়বে। -বুখারী, হাদিস নং- ৭০৭৬
১০. তাকে হিংসা না করা, অথবা তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ না করা, অথবা তাকে ঘৃণা না করা, অথবা তার পিছনে গোয়েন্দাগিরি না করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا
হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না। সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১২
১১. তার সাথে ধোঁকাবাজি বা প্রতারণা না করা; তার সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা, অথবা তার খিয়ানত না করা, তার সাথে মিথ্যা কথা না বলা, তার ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে টাল-বাহানা না করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে, সে হবে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত মুনাফিকের একটি স্বভাব তার মধ্যে থেকে যাবে; স্বভাবগুলো হল: আমানত রাখলে খিয়ানত করে, কথা বললে মিথ্যা বলে, চুক্তি করলে ভঙ্গ করে এবং ঝগড়ায় লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষায় কথা বলে। -সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৩৪
১২. বড় হলে তাকে সম্মান করা; আর ছোট হলে তাকে স্নেহ করা। হাদীসে এসেছে, আল্লাহর নবী ﷺ বলেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের বড়কে সম্মান করে না এবং ছোটকে স্নেহ করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। নিজ থেকে তার প্রতি ইনসাফ করা এবং তার সাথে এমন ব্যবহার করা, যে ব্যবহার সে নিজে অন্যের কাছ থেকে আশা করে; তার কল্যাণকামী হওয়া। রসূলুল্লাহ ﷺ সকলের কল্যাণকামী ছিলেন। তাকে দেখলে মানুষের মনে এই আশা জাগত যে, আমার নিকট এমন একজন ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছেন’ যিনি আমার কল্যাণকামী।
১৩. সে যখন আল্লাহর নামে আশ্রয় চাইবে, তখন তাকে আশ্রয় দেওয়া; যখন তার কাছে আল্লাহর নামে সাহায্য চাইবে, তখন তাকে দান করা; তার ভালো কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা ও সর্বদা তার জন্য কল্যাণের দুআ করা। আল্লাহ তায়ালা উত্তম তাওফিক দাতা।
খুলনা গেজেট/ এস আই