হাড়িয়া ও সালতা নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে বারোআড়িয়া। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সীমানায় এর অবস্থান। বারোআড়িয়া প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। দিনটি একাত্তরের ২৯ নভেম্বর। যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডল ও মোল্লা আব্দুল আজিজ শহীদ হন। প্রতিবছর দিনটি স্থানীয়রা নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে আসছে।
বারোআড়িয়া বাজারের কাছে মনি গোলদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে গড়ে ওঠে রাজাকার ক্যাম্প। রাজাকাররা স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর দমন ও নিপীড়ন শুরু করে। বাড়ি-ঘর লুটপাট করে। হিন্দু-সম্প্রদায়ের সম্পদে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেখানে ধর্ষিতের সংখ্যা বেড়ে চলে গাণিতিক হারে। কায়েম হয় ত্রাসের রাজত্ব। রাজাকারদের হাতে এলাকাবাসী জিম্মি হয়ে পড়ে (বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী রচিত স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান)। রাজাকারদের অত্যাচারের কাহিনী পাইকগাছা থানার মুজিববাহিনীর সদর দপ্তরে বৃহত্তর খুলনা মুজিববাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু (বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান) এর কাছে পৌঁছায়। তিনি বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প শত্রুমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ বটিয়াঘাটার চক্রাখালী গ্রামের বিনয় সরকারকে অধিনায়ক করে ২০ থেকে ২২ জনের একটি দলকে বারোআড়িয়া ক্যাম্প আক্রমণের নির্দেশনা দেন, জেলা মুজিববাহিনীর প্রধান।
২৮ নভেম্বর রাতে এ যুদ্ধের অধিনায়ক বিনয় সরকার সহযোদ্ধাদের নিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হন। গভীর রাতে বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি পৌঁছায়। এ দলটিকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন মুক্তিবাহিনীর চণ্ডিপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক ডুমুরিয়ার নুরুল ইসলাম মানিক ও তাঁর সহযোগী আবু ওয়াহিদ সিনা মিকি (মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ গবেষণা ফাউন্ডেশন, খুলনার প্রকাশনা রক্তে রক্তে স্বাধীনতা)। নুরুল ইসলাম মানিকের নির্দেশে আবু ওয়াহিদ সিনা মিকির নেতৃত্বে সাতজনের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বিনয় সরকারের নেতৃত্বাধীন সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের বিপরীতে মসজিদ ও বিভিন্নস্থানে অবস্থান নেয়। যুদ্ধের অধিনায়ক বিনয় সরকার ডানে, উপ-অধিনায়ক মোল্লা আব্দুল আজিজ ও আবু ওয়াহিদ সিনা মিকি বামে অবস্থান নেন। পরিকল্পনানুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান রাজাকার ক্যাম্পের বিস্ফোরক দ্রব্য বেঁধে রেখে আসে। কিছুক্ষণ পর তা বিস্ফোরণ ঘটে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, রাজাকার ক্যাম্পটি ধ্বংস হয়নি। এতে কয়েকজন রাজাকার আহত হয়। তারা রাজাকার ক্যাম্পের দোতলা থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে গুলি শুরু করে। একপর্যায়ে যুদ্ধের উপ-অধিনায়ক আব্দুল আজিজ মোল্লা গুলিবিদ্ধ হন। আহত আজিজকে চিকিৎসার জন্য নৌকাযোগে পাঠানো হয়। পতিমধ্যে তিনি শহীদ হন। অধিনায়ক বিনয় সরকার ও জ্যোতিষ মণ্ডল আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা আব্দুল আজিজকে চিকিৎসার জন্য রওনা করে অধিনায়ক বিনয় সরকার ও জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ওপর এসে হাজির হন।
অধিনায়ক বিনয় সরকারের বর্ণনা অনুযায়ী এরই মধ্যে একটি গুলি এসে জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডলের মাথায় লাগে। ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন। তাদের লাশ মুজিববাহিনীর বেতোডাঙ্গা ক্যাম্পে আনা হয়। বৃহত্তর খুলনা মুজিববাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর পরামর্শ অনুযায়ী মোল্লা আব্দুল আজিজের মরাদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি পাইকগাছার চাঁদখালীর মৌখালী গ্রামে পাঠানো হয়। জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডলের লাশের সৎকার করা হয় যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী পাতলাবুনিয়া ইসকন মন্দির প্রাঙ্গণে। অধিনায়ক বিনয় সরকার একাই পাঁচজন রাজাকারকে হত্যা করতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধে ১৬জন রাজাকার বন্দী হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন, খন্দকার খায়রুল কবির লনী, বজলুর রহমান, মাহাবুব, আবু ওয়াহিদ সিনা মিকি, হরিপদ মল্লিক, নুরুল ইসলাম খোকন, নুরুল ইসলাম মানিক, শামসুর রহমান, বাগমারার তপন কুমার বিশ্বাস, বটিয়াঘাটা ফুলতলার মুকুল বিশ্বাস, বয়ারভাঙ্গার মনোরঞ্জন মণ্ডল ও দেবীতলার অমরেশ প্রমূখ।
খুলনা গেজেট / এআর