খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯ পৌষ, ১৪৩১ | ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  আরও ৬০ দিন বাড়ল সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা
  রমজান ও ঈদের সম্ভাব্য তারিখ জানাল আরব আমিরাত
  দেশে একজনের শরীরে এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত : আইইডিসিআর

মিয়ানমারের আকাশে কী আলোর রেখা!

গৌরাঙ্গ নন্দী

মিয়ানমারের পরিস্থিতি বেশ খারাপ। তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জের ধরে অনুমিতভাবেই আক্রান্ত বা পীড়িত দুর্বল গোষ্ঠী সীমান্ত পেরিয়ে সংলগ্ন দেশে আসছে। সেই ঢেউ বাংলাদেশে যেমন পড়েছে, তেমনি ভারতেও পড়েছে। বাংলাদেশে সেই দেশের গোলা এসে পড়েছে, তাতে মানুষ মারাও গেছে। সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলো থেকে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছে।

মিয়ানমার অর্থাৎ সাবেক বার্মার অভ্যন্তরীণ এই সংকট ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই শুরু। সেখানকার ক্ষুদ্র জাতি-স্বত্ত্বাগুলো তাদের স্বাধিকার-স্বায়ত্তশাসনের লড়াই তখন থেকেই শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সরকার অন্যান্য জাতিগুলোর স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করলেই তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সেই থেকেই একাধিক স্বাধীনতাকামী-বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অবস্থান ছিল। যারা কখনও কখনও অনেক বেশী সক্রিয় হতো। সত্তর বছরের অধিক সময় ধরে স্বাধীনতাকামীদের এই কার্যকলাপ বর্তমানে একটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ যে বামাররা (প্রায় ৭০ শতাংশ) এতোদিন অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগুলোর (শতাধিক জাতিগোষ্ঠী) স্বাধীনতা-স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেয়নি, তারাও এখন সেই দাবির প্রতি একাত্ম হয়েছে এবং নিজেরাই একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তুলে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে মিলেমিশে সামরিক জান্তা বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। এবারকার লড়াইয়ের গুণগত পরিবর্তনটি হচ্ছে, যে বামাররা এতোদিন সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে আসছিল, অথবা সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের সুবিধাভোগী ছিল, সেই বামার জনগোষ্ঠী সেনাবাহিনী বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে, যদি সামরিক জান্তা পরাজিত হয়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের এই মনোভাব কী অটুট থাকবে, অর্থাৎ তারা কি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য-স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে!এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং সামরিক জান্তার পরাজিত হওয়া দেখতে হবে।

এই মুহূর্তের বড় প্রশ্ন, সামরিক জান্তা কী পরাজিত হতে চলেছে? জান্তা-বিরোধী লড়াইয়ের খবরগুলো বেশ উদ্দীপনাময়। সামরিক শাসনের খোলসে পোরা বার্মা-মিয়ানমারে সুচি’র শাসনামলে একটু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। সুচি’র দল সেনাবাহিনীকে তুষ্ট করেই বেসামরিক লেবাসে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে প্রায় অস্বীকার করেই দেশ শাসন করছিল। সেখানে সামরিক স্বার্থের অদ্ভূত সমন্বয় ঘটেছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী আবারও মঞ্চে আসে। এবারকার সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ শাসনের তিন বছর পূর্তি হয়েছে। শুরুর দিকে সেনা-বিরোধী গণ-আন্দোলন সংগঠিত হয়, যাতে মূলত: ছাত্র-যুবাদের প্রাধান্য ছিল, তাতে সামরিক জান্তার দমন-পীড়ন ছিল বেশ। অনেকেই আন্দোলনে প্রাণ হারান, যার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক জান্তা বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়, বিশেষত: সংখ্যাগরিষ্ঠ বামাররাও রুষ্ট হয়। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বামাররা ক্ষুদ্র জাতিগুলোর লড়াই ও তাদের দাবির প্রতি নমনীয় হয়। গড়ে ওঠে সামিরক জান্তা বিরোধী একটি বৃহত্তর ঐক্য। যে ঐক্যের ফল হিসেবে ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর সেদেশের সেনা-ছাউনিগুলোতে একটি পরিকল্পিত আক্রমণ পরিচালিত হয় এবং সফলতা আসে। সেই থেকেই মিয়ানমার আবারও আন্তর্জাতিক খবর হতে শুরু করে। জান্তাবিরোধী আক্রমণের সফলতার খবর আসতে থাকে।

এই লড়াইয়ে সামরিক জান্তা কী পরাস্ত হবে? এই প্রশ্নের জবাব এখুনি পাওয়ার সুযোগ নেই। সময় প্রয়োজন। তবে এটি স্পষ্ট যে, মিয়ানমারে বিদেশীদের স্বার্থ এই লড়াইয়ের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে। মিয়ানমারে চীন সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। আছে ভারতের স্বার্থ। আমেরিকাও বসে নেই। তবে আমেরিকার প্রভাব কোনভাবেই চীন বাড়তে দিতে চায় না। মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ অনেক বেশী। ভারতেরও বিনিয়োগ আছে। আমেরিকার নানান ধরণের সহায়তা আছে। আর চীন-রাশিয়ার সামরিক সহায়তা আছে সামরিক জান্তা সরকারের প্রতি; আবার চীনের সামরিক সহায়তা আছে একাধিক বিদ্রোহী বা স্বাধীনতা-স্বায়ত্তশাসিতকামী গোষ্ঠীর উপর। এরই মাঝে চীন সংলগ্ন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়েছে চীনের মধ্যস্থতায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, চীন চায় না সেদেশের সামরিক-শাসকের পরাজয় ঘটুক, কারণ তারপর কারা, কিভাবে ক্ষমতায় আসবে এবং মিয়ামনার কী একটি দেশ, না-কি একাধিক দেশ-এ রূপান্তরিত হবে, তার আশঙ্কা রয়েছে। একাধিক দেশ হলে চীনের স্বার্থ অটুট রাখতে একাধিক গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করতে হবে। একাধিক গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতার চেয়ে একটি গোষ্ঠীর সাথে ফয়সালা করা অনেক সহজ। আবার যদি একাধিক দেশ হয়েই যায়, তখনও যাতে চীন তার স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে সফল হয়, সে কারণে বিদ্রোহীদের সাথে সখ্য এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে চলেছে।

বর্তমানে সামরিক জান্তা বিরোধী আক্রমণ অনেক বেশী জোরদার হয়েছে। যার জের হিসেবে সীমান্ত পেরিয়ে নির্যাতিতরা প্রতিবেশী দেশে ঠাঁই নিচ্ছে। সেনা ছাউনিগুলোর পতন ঘটেছে, ঘটছে; কিন্তু রাজধানী নেপিডো এখনও অনেক বেশী মজবুত, সুরক্ষিত। সেনা-শাসকদের পতন ঘটবে কী-না, তা বিরোধী সশন্ত্র গোষ্ঠীগুলোর যুথবদ্ধতা, বাইরের মিত্রদের সাথে সখ্যতা ও সফল আক্রমণের উপর নির্ভর করছে। বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বামার বা বৌদ্ধগোষ্ঠীর মনোভাবের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বামাররা যদি উদার হয়, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকার-স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অধিকতর নমনীয় হয়, তাহলে সামরিক জান্তাকে পরাজিত এবং একটি ফেডারেল ব্যবস্থার মিয়ানমার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে; অন্যথায় মিয়ানমার ভেঙ্গে একাধিক রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। বিপরীতে, সামরিক জান্তার নিপীড়নের তলায় বিরোধীরা নিষ্পেষিত হয়ে মিয়ানমার আবারও এক অন্ধকার শাসনের ঘেরাটোপে বন্দী হতে পারে।

খুলনা (বাংলাদেশ); ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২৪। (ফেসবুক ওয়াল থে‌কে)

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!