চারদিন আগে ভারতের মাটি থেকে উৎক্ষিপ্ত হওয়া একটি মিসাইল পাকিস্তানের ভূখন্ডে আছড়ে পড়ার ঘটনায় ইসলামাবাদ এখন ‘যৌথ তদন্তে’র দাবি জানাচ্ছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর আগে বলেছিল, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ওই মিসাইলটি ‘দুর্ঘটনাবশত’ ফায়ার করা হয়েছিল এবং কোর্ট অব এনকোয়ারিতে তারা এই ঘটনার তদন্ত করবে।
কিন্তু শনিবার রাতে পাকিস্তান এক দীর্ঘ বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে, এরকম গুরুতর একটি ঘটনায় ভারতের নিজস্ব তদন্ত যথেষ্ঠ নয় – বরং আসলে কী ঘটেছিল সেটা জানতে দুই দেশকে এক সঙ্গে মিলেই তদন্ত করতে হবে।
ভারত অবশ্য এই দাবিতে এখনও কোনও সাড়া দেয়নি।
ইতিমধ্যে দুই দেশের সামরিক বিশেষজ্ঞরাই প্রায় একবাক্যে বলছেন যে ঘটনা বা দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেটি এক কথায় মারাত্মক বিপজ্জনক।
গত বুধবার সন্ধ্যায় ভারতের হরিয়ানায় সিরসা থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে একটি সুপার-সোনিক মিসাইল সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় সোয়াশো কিলোমিটার ভেতরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি গ্রাম মিঁয়া চান্নোতে আছড়ে পড়ে।
ওই ক্ষেপণাস্ত্রে অবশ্য কোনও বিস্ফোরক বা ওয়ারহেড ছিল না – পাকিস্তানের মাটিতে সম্পত্তির কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও ওই মিসাইলের আঘাতে কোনও প্রাণহানিও হয়নি।
ভারত এটিকে নেহাত একটি দুর্ঘটনা বলে দাবি করলেও পাকিস্তান কিন্তু সেই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয় বলেই ক্রমেই পরিষ্কার করে দিচ্ছে – আর এই ‘মিসাইল লঞ্চ’কে কেন্দ্র করে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের মধ্যে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠছে।
যেদিন মিসাইলটি পাকিস্তানে আছড়ে পড়ে, সে দিনই বেশি রাতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল বাবর ইখতিয়ার বলেছিলেন, “খুব দ্রুত গতিতে একটি উড়ন্ত বস্তু যে ধেয়ে আসছে, আমাদের বিমান বাহিনীর এয়ার ডিফেন্স অপারেশন সেন্টার সেটি টের পেয়েছিল ভারতের আকাশে থাকার সময়েই।”
“হঠাৎ করে প্রাথমিক গতিপথ পরিবর্তন করে সেটি পাকিস্তানের দিকে আসতে থাকে – এবং একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৫০ মিনিটে মিঁয়া চান্নোতে আছড়ে পড়ে।”
সেই মিসাইল লঞ্চের প্রায় দেড় থেকে দুদিন পর শুক্রবার ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, রুটিন রক্ষণাবেক্ষণের সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই ভুলবশত একটি মিসাইল ফায়ার হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনায় দু:খ প্রকাশ করে তদন্তেরও আশ্বাস দেওয়া হয়।
কিন্তু সে দিনই পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মঈদ ইউসুফ টুইট করেন, এত মারাত্মক একটা ঘটনার কথা জানাতেও যারা দুদিনের বেশি সময় নেয় – সেই ভারতের কথা কোনও মতেই বিশ্বাস করা চলে না।
এই লঞ্চ অনিচ্ছাকৃত, না কি আসলে ইচ্ছে করেই কিছু করা হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখার জন্য তদন্তেরও দাবি জানান তিনি – আর তার সেই বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটে পরদিন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।
যৌথ তদন্তের দাবি জানানোর পাশাপাশি তারা ভারতের উদ্দেশে তাদের ভাষায় সাতটি ‘মৌলিক প্রশ্ন’ও ছুঁড়ে দেয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাবেক লে: জেনারেল নাঈম খালিদ লোদি অবশ্য এর পরেও মনে করছেন না পাকিস্তান এই ইস্যুতে যথেষ্ঠ কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, “নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মিসাইল আছড়ে পড়ার ঘটনাকে ফরেন অফিসের যতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত ছিল ততটা তারা মোটেই পারেনি।”
“শুধু বেসামরিক প্রাণহানি নয়, এই ঘটনা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্যও কতটা বিপজ্জনক সেটা কি তারা আদৌ উপলব্ধি করেছে? আমি মনে করি বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদেও তোলা উচিত ছিল।”
গোটা ঘটনায় ভারত যে চরম বিব্রত, দিল্লিতেও স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞরাও তা স্বীকার করছেন – কিন্তু সেই সঙ্গে তারা এটিকে একটি ‘অনেস্ট মিস্টেক’ বা অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবেই দেখতে চান।
সামরিক গবেষক মারুফ রাজা যেমন বলছিলেন, “এটা একটা দুর্ঘটনাই – কারণ ওই সময়ের আশেপাশে পাকিস্তানের দিক থেকে কোনও উসকানি ছিল না, আর অনির্দিষ্ট নিশানায় হঠাৎ করে একটা মিসাইল ছুড়ে ভারত কোনও বার্তাও দিতে চাইবে না।”
“তবে এই ধরনের মিসাইল কিন্তু নিজে থেকে উৎক্ষিপ্ত হয় না – বা ভুল করে একটা বাটনে হাত পড়লেই আকাশে ছিটকে গেল, তাও নয়। ওগুলোর লঞ্চের জন্য সুনির্দিষ্ট চ্যানেল অব কমান্ড বা অথরাইজেশন থাকে।”
“আর ঠিক সেই জন্যই এই ঘটনায় ভারতের মিসাইল অপারেটিং প্রসিডিওর-টাই গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত, কারণ একটি পরমাণু শক্তিধর দেশের কাছ থেকে এই মাপের দুর্ঘটনা কিন্তু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।”
বিষয়টি পাকিস্তানকে জানাতে ভারত কেন চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় নিয়েছে. ভারতেও অনেক বিশ্লেষক তার সমালোচনা করছেন।
আর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে মার্কিন নিরাপত্তা পরিষদের সিনিয়র উপদেষ্টার পদে থাকা জোশুয়া টি হোয়াইট টুইট করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যে কোনও সময় এসক্যালেশন বা যুদ্ধের ঝুঁকি আছে – এই মিসাইল পর্ব পশ্চিমী দুনিয়ার সেই আশঙ্কাকেই আরও জোরালো করবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
খুলনা গেজেট/এএ