খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

মামার বন্দিদশার বন্ধু

আসিফ কবীর

সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিতে হলো। শীত-শীত বোধ হওয়ায় গরম পানির দরকার হলো গোসল করার জন্য। আগে থেকে বলে রাখা গাড়ি নিচে অপেক্ষা করছিল। গাড়ি নিয়ে প্রথম গেলাম হোটেল রয়্যাল ইন্টারন্যাশনালের গাড়ি বারান্দায়। এরপর কিছুক্ষণ রিসেপশনে অপেক্ষা করতেই চলে এলেন অধ্যাপক বিধান চন্দ্র রায়। দু’জনে একসাথে রিসেপশন থেকে ইন্টারকমে আসার খবর জানালে অল্প পরেই নামলেন আমার মামা ও মেম মামি। মামা একটি হালকা জ্যাকেট পরে আছেন, বুক খোলাই রেখেছেন। মেম মামি শীত নিবারণে কার্ডিগান পরেছেন। মামার গলায় ঝোলানো নাইকন ডিএসএলআর ক্যামেরা, পায়ে বোটম্যান স্যু। সাথে ছোট হাতব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়েছেন। হোটেলে অর্ডার করা কিছু খাবারও গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। এরপরই আমরা রওনা হলাম সাগরদাঁড়ির উদ্দেশে।

সাগরদাঁড়ি যশোহরের মধ্যে হলেও খুলনা থেকেই বেশি কাছাকাছি হয়। ডুমুরিয়ার মধ্য দিয়ে কেশবপুরের মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক বাড়ি সাগরদাঁড়িতে যাব আমরা। রাস্তার দুধারে রবিশস্য উঠে গিয়ে খরিপ শস্য চাষের জমি প্রস্তুত করা হয়েছে। জমির আলে আলে খেজুরগাছ। কিছুদিন আগে রসের জন্য কাটা হয়েছিল বলে অন্য একটি চেহারা এসেছে। রস সংগ্রহের হাঁড়িও বাঁধা থাকতে পারে দু-একটিতে। চলন্ত গাড়ি থেকে সবটা বোঝা যায় না। সেচের জন্য নালা কাটা। তাতে এখনো পানি রয়েছে। সূর্যের তাপ এখনো পেলব, সকাল বলে দূরে জনবসতি আর গাছপালার সবুজ রেখার আগ দিয়ে পাতলা কুয়াশার মায়াময় আবেশ ছড়ানো যেন।

আমরা পৌঁছালাম সাগরদাঁড়ি। একটি নামফলকও রাস্তায় দেওয়া। পূর্ববঙ্গের প্রথাগত জমিদার বাড়ির প্রাসাদোপম স্থাপনাটিই কবি মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক ভিটা। সামনে বিরাট উঠোন, তিন দিকে স্থাপনা, একদিকে প্রবেশদ্বার। বিরাট পারিবারিক পূজার স্থান। পিঠাপিঠি সংগীত বা জলসার চত্বর। এটি নাকি নয় ফিট নিচু ছিল, এখন মাটি ভরাট করা হয়েছে। তিনপাশে দর্শকেরা জড়ো হয়ে উপভোগ করতেন নৃত্য কিংবা সংগীত পরিবেশনা। হলুদ রং করা, সংস্কারের পর, তবু নির্মাণশৈলীর ধারণা পাওয়া যায়। উনিশ শতকের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলো যেমন হয়। আশেপাশে কয়েক ঘর কবির পিতৃব্যদের বসতবাড়ি।

আমাদের মতো আরও অনেক দর্শনার্থীই এসেছেন কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা দেখতে। তখনকার দিনে এমন বিরল যোগাযোগ এলাকায় এমন নির্মাণশৈলীর বাড়ি যেখানেই দেখেছি, আমার অবাক লেগেছে। এসব ক্ষেত্রে খুবই প্রচলিত একটা কথা হলো কলকাতা থেকে কারিগর এনে তৈরি করা। ভিক্টোরিয়ান নকশা শোভিত স্তম্ভ, ঢালাই রেলিং, শার্সি দরজা, ঘরের ছাদের চতুর্দিকের নকশা…সবই প্রশংসার। একটি লাল বাঁধাই তুলসি মন্ডপ দেখলাম। সেটি কবির ভূমিষ্ঠ হওয়ার স্থান বলে ফলকে লেখা। এখানে গাইডের কাছেও বেশ কিছু বর্ণনা আর তারচেয়ে বেশি মিথ শোনা গেল। একটি কাঠের সিন্দুক দেখলাম কবির পরিবারের ব্যবহৃত। কপাট উপরের দিকে। গাইড বললেন, এর উপরে বিছানা পেতে ঘুমানো হতো। ভিতরে থাকত মূল্যবান সামগ্রী। কাঠের আসবাবগুলো কয়েকশ’ বছরের পুরাতন হলেও এখনো প্রায় ঠিকঠাক আছে। কিছু ব্যবহার্যের বর্ণনার পাশাপাশি গাইডের মানবেতর জীবনের কথাও শুনলাম আমরা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রকল্প নিয়ে কবির জন্মভিটা সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়। জমিদার বাড়ির চারপাশে দেয়াল তোলা হয়। একটি স্মৃতি জাদুঘর করে উন্মুক্ত করা হয় দর্শনার্থীদের জন্য। তখন কয়েকজন গাইড, কিউরেটর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ পান। তারা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভক্ত, এই গ্রামেরই সন্তান। দরদ দিয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেল। এর কিছুদিন পর প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হলো। জোট সরকার আর তা নবায়ন করল না। এরপর থেকে বেতন বন্ধ তাদের। আয় রোজগার নেই, অভাব-অনটনে মানবিক সংকট শুরু হয়েছে প্রত্যেকের পরিবারে। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। মেম মামির মনে ঘটনাটি বেশ রেখাপাত করল। যদিও কাহিনি কিছুই বুঝলেন না তেমন। বাংলাদেশের প্রতিহিংসার রাজনৈতিক বাস্তবতা তার বোঝারও কথা নয়। প্রবাসী মামা তাদের কিছু বকশিশ দিলেন। আমরা মূল ভবন থেকে বেরিয়ে কবির ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়ালাম। এনামেল পেইন্ট চড়িয়ে কিছুটা কবির আইকনিক দাড়ি চুলের বর্ধিত অংশের মতো করে এঁকে দেওয়া হয়েছে। নিচের বেদিতে তাঁর নাম, জন্ম-মৃত্যু লেখা আছে। তাতে ভাস্কর্যটি তাঁর বলে বোঝা গেলেও শিল্প হিসেবে কবির অবয়বের কাছাকাছিও নয়। আমরা এখানে অন্যদের দেখাদেখি ছবি তুললাম।

গাইডের কবিকে নিয়ে বলা মিথগুলো এ সময় বারবার মনে আসছিল। ১৮৬২ সালে কবি এ জন্মভিটায় এসেছিলেন। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য প্রত্যাখ্যাত হন জ্ঞাতিদের কাছে। একটি মৃত কাঠবাদাম গাছতলা দেখিয়ে গাইড বলেছিলেন, এর তলায় তাঁবু খাটিয়ে দুই সপ্তাহ মতো থেকে কপোতাক্ষ নদের পাড় ধরে হেঁটে, বিদায়ঘাট থেকে জলযান করে কলকাতা ফিরে যান। বিদায়বেলায় কবি বলেছিলেন, একদিন আমার পরিচয়েই এই ভিটেকে সকলে চিনবেন। ফলে গেছে তাঁর কথা।

আমরা কপোতাক্ষ নদ দেখতে গেলাম কিছুদূর হেঁটে। নদ মরে গেছে। টোপাপানা আর প্লাংটনে ভর্তি। একটি নৌকা পাওয়া গেল ঘাটে। আমরা চারজন উঠলাম কবির কপোতাক্ষে কিছুটা ভ্রমণ করব বলে। মামার আগ্রহ ছিল বেশি। আমাদের সাথে আসা অধ্যাপক বিধান চন্দ্র রায় নৌকায় বসে কবিকে নিয়ে আলোচনা করলেন কিছুক্ষণ। বাংলা আধুনিক কবিতার জনক তিনি। পাশ্চাত্য ও বাংলা কাব্যরীতির যূথবদ্ধ যাত্রা তাঁরই হাত ধরে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ, সনেট ধারা তিনিই শুরু করেন। বাংলা নাটকে আধুনিকতা তিনিই আরোপ করেন। মেঘনাদ বধ কাব্যগ্রন্থটি তাঁর এক অতিআধুনিক ভাবনায় লিখিত। তিনি চিরায়ত মন্দ চরিত্রকে নায়করূপে দেখিয়েছেন তাঁর অসামান্য কাব্য প্রতিভার প্রকাশে। সাহিত্যের যে শাখায়ই তিনি হাত দিয়েছেন, তা-ই নতুনত্বের শিরোপা পেয়েছে। নৌকায় বসে গাইডের কপোতাক্ষ ও মাইকেল মধুসূদনকে নিয়ে বলা মিথগুলোও আমরা আলোচনা করলাম কিছুক্ষণ। গাইড বলেছিলেন, কবি পাড়ে বসে কপোতাক্ষের সৌন্দর্য দেখতে এতই ভালোবাসতেন যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে প্রিয় নদীপাড়ে (প্রকৃতপক্ষে নদ) কাটিয়ে দিতেন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। মা জাহ্নবী দেবী খাবার বেড়ে বসে থাকতেন। কবির সে খেয়াল থাকত না। আজকের চেহারায় নদের শীর্ণ রূপ এই বর্ণনার পাশাপাশি বড়ই বেমানান। ঘাটে ফিরতে ফিরতে আমার মনে পড়ল, ছোটবেলায় শুনতাম এ নদীতে কবি পয়সা ছুড়ে ছুড়ে ফেলতেন অকাতরে। অঢেল ঐশর্য ছিল বোঝাতে এমন গল্প প্রচলিত ছিল।

খুলনা-যশোহর অঞ্চলে শিশু শিক্ষা বেলাতেই এলাকার কৃতী সন্তান বলে সত্য-মিথ্যা নানা মিথের মোড়কে মাইকেল মধুসূদন চর্চা হয়। একাদশ শ্রেণিতে পাঠ্য তাঁর কবিতা ‘সমুদ্রের প্রতি রাবণ’ পাঠ করায় একটি খেলার উদ্ভব করেছিলাম আমরা। মনে পড়ে যায়। পুরো কবিতা পাঠে কার কয়টি উচ্চারণ বেধে যায় বা ভুল হয়। এ কবিতাটি তাঁর ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য থেকেই সংক্ষেপিতভাবে নেওয়া। শিক্ষকেরা বলতেন, এ মহাকাব্যে যে রাবণকে মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে, কবি তাকেই প্রধান চরিত্র করে নতুন ধারার সাহিত্য সৃষ্টি করেন। ইভিল আত্মার মাঝেও নান্দনিকতা জুড়ে দিয়ে তাকেই মহিমাময় করে দেখান। লেখক হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর আগে আগে ‘দেয়াল’ উপন্যাসে এমন একটি প্রয়াস নেন। সে বইটি পাঠের সময়ও মধুসূদনের কথা মনে পড়েছিল প্রসঙ্গক্রমে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর এক বন্ধু গৌরদাস বসাককে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন বলে দশম শ্রেণিতে জেনেছিলাম। তখন আমি একটি রেসিডেনশিয়াল স্কুলের ছাত্র। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি। কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষর পাশাপাশি লিখলে তার বন্ধুর নাম দাঁড়ায়। অবাক লেগেছিল কীভাবে এটা সম্ভব? শব্দচয়ন ও সৃজনীক্ষমতা কত প্রগাঢ় হলে এটি পারা যায়!

নৌকা ঘাটে এসে গেল। মামা বললেন, ‘সকাল সকালই তো সব হয়ে গেল। হাতে সময় আছে এখনো অনেক। নদীটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। চল, কেশবপুরের আশপাশে আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে, পারলে তার সাথে দেখা করে যাই। ওর বাড়ির ঠিকানা নেই, তবে শুনে শুনে চলে যাওয়া যাবে। গ্রামে তো সবাই সবাইকে চেনে। আর বললে হবে অনেক দিন বিদেশে ছিল। লেবাননে যুদ্ধও করেছে। নাম রফিক। পরে জার্মানি চলে গেছিল। বেশ কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে আসছে।’

আমরা সত্যি সত্যিই সুনির্দিষ্ট ঠিকানা ছাড়া মানুষজনের কাছে শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম রফিক সাহেবের বাড়িতে। গ্রামবাংলার আসঞ্জনশীলতার এ এক অদ্ভুত বন্ধন। রফিক সাহেবের পৈতৃক বাড়ি বলতে সকলে যেদিকে নির্দেশ করলেন, সে ঠিকানায় পৌঁছে একটি আটপৌরে গ্রামীণ গৃহস্থ বাড়ি দেখতে পেলাম আমরা। রফিক সাহেবের কথা বলতেই সবাই কেমন যেন করতে শুরু করল। তার বাড়ি কি না, তিনি আছেন কি নেই…কেউ কিছু বললেন না। কেউ যেন কথাও বলতে দ্বিধান্বিত। উঠানে আমরা চারজন অপেক্ষা করতে থাকলাম। পাঁচ অংশে আলাদা আলাদা পাঁচটি ইটের উপরে টালির চালা বাড়ির স্থাপনা। পাঁচ অংশে আলাদা আলাদা পাঁচটি কাঁচা বাড়ির স্থাপনা। বাড়ির মেঝে সুন্দরভাবে লেপে রাখা। উঠোন পরিচ্ছন্ন। প্রবেশপথের একদিকে রান্নাঘর। বাকি চারভাগে বসতবাড়ি। বোঝা যায় যৌথ পরিবারের বসবাস। চারকোণে একেকটি অংশের শেষে কোনো না কোনো গাছ। একটি অংশের চালায় লাউ বা কুমড়োর ডগা দেখা যায়। প্রবেশপথের বিপরীত দিকের ঘরের সারির পেছনে সুপারিগাছ কয়েকটি। এসব দেখতে দেখতে চারটি চেয়ার এলো উঠোনে বসার জন্য। কিন্তু তখনো কেউ কথা বলতে এগিয়ে এলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজন মধ্যবয়সী মহিলা এলেন বাইরে থেকে। তিনি এসে বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলে এগিয়ে এলেন আমাদের প্রতি।

পরিচয়ে জানা গেল, তিনি রফিক সাহেবের বোন। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আমরা এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম, ঠিক বাড়িতেই এসেছি আমরা। তবে রফিক সাহেব এখানে থাকেন না। আমরা কেন, কোত্থেকে এসেছি, আমাদের সাথে কথা বললে লাভ না ক্ষতি কী আছে, তা না জেনেই কেউ কথা বলতে চাচ্ছিলেন না। রফিক সাহেবের বোন আসায় সকলের সাথে পরামর্শ করে তিনিই কথা বলতে এসেছেন। এর পরপরই বাড়ির সকলে এসে গেল। তাদের আর কথা বলায় আপত্তি নেই। মেম মামিকে দেখতে প্রতিবেশীরাও জড়ো হলেন। বউঝিরা তাড়াহুড়ো করে আসতে কোলের সন্তানদের ঠিকমতো বা একদমই কাপড় পরিয়ে আনেননি। শিশুদের আদুল গায়ে কোমরে বাঁধা ঘুঙুর বা তাবিজ দেখা গেল। একজন অতি উৎসাহী মেম মামিকে প্রশ্ন করলেন ভাঙা ইংরেজিতে, আপনার নাম, আপনি কোন দেশের, এ দেশ কেমন? রফিক সাহেবের বোনের বর্ণনায় জানা গেল, জার্মানির প্রবাস জীবন থেকে ফেরার পর ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়েন রফিক সাহেব। মাথার অসুখ, প্রকৃতপক্ষে মনের অসুখ। সবাইকে সন্দেহ আর অবিশ্বাস করতে থাকেন ক্রমেই। একসময় বাড়াবাড়ি হয়ে যায় অবস্থা। তখন বলতে থাকেন পরিবারের লোকেরা তাকে মেরে ফেলবেন। এ অবস্থায় অনেক রকম চিকিৎসা চলতে থাকে। কোনো লাভ হয় না। একপর্যায়ে গ্রামের সদর রাস্তার সাথে একটি খাবার হোটেলের এক দিকে আলাদা করে তাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা জেনে নিলাম সেই হোটেলের পথনির্দেশনা। বলতে বলতে শিক্ষিকা বোন কাঁদতে থাকেন অঝোরে। উপস্থিত অনেকেই তার কথায় সায় দেন। এমন অভিনবত্বে আমার আকাঙ্খা আরও বেড়ে গেল মামার বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের। আমাদের আরও সময় থেকে, দুপুরে ডালভাত খেয়ে যেতে আন্তরিকভাবেই বললেন বাড়ির প্রায় সকলেই। কিন্তু তখন আমার খেয়াল মামার বন্ধুকে ধরতে হবে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

খুব দূরে নয় সেই খাবার হোটেলটি। পেতেও কষ্ট হলো না। ছাপরা ঘর। কয়েকটি টেবিল-বে । আজকের দুপুরের জন্য রান্না খাবার কয়েকটি বড় ডিশে রাখা। ক্যাশিয়ার, হোটেল বয়রা, আর খাওয়া-দাওয়া করছেন জনা কয়েক লোক। এই পরিসর। খুব সুব্যবস্থা নয়। এরই একদিকে বাঁশ আর চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে একটি আড়াল তৈরি করা। সেখানে একটি চৌকি, সস্তা আম কাঠের, ওপরে সবুজে খোপকাটা ছাপার মশারি। নেটের মশারি না। পাতলা কাপড়ের মশারি, বাতাস চলাচল হয় অপ্রতুল। একটি টেবিল ফ্যান মশারির মধ্যে। আলো কম। আর তেমন কিছু বোঝা গেল না। হোটেল ম্যানেজার শনাক্ত করলেন, মশারির মধ্যে এখনো, ঘুম থেকে তিনি জাগলেও বের হয়ে আসেননি, তিনিই রফিক সাহেব। তাকে হোটেল ম্যানেজার ডাকাডাকি করে বের করে আনলেন। লুঙ্গি পরিহিত, গায়ে গোল গলা গেঞ্জি। পোশাক পরিপাটি হওয়ার কথাই না, কিন্তু চুল দাড়িও অতিশয় অবিন্যস্ত, উভয়ই কাঁচা পাকা। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে, যে সময়ের কথা বলছি এর কয়েক বছর পর, কোনো এক কোরবানির ঈদের আগে ফাঁসির পূর্বে যেমন চেহারায় বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তারই মতো যেন রফিক নামের এ মানুষটিকে প্রথম দেখায় আমরা দেখলাম। ইরান দেশের ডাবিং করা চলচ্চিত্রে জীবনযুদ্ধে পরাজিত বা বিপর্যস্ত চরিত্রটি যেমন চেহারা ফুটিয়ে কাস্ট করানো হয়, তেমনও বলতে পারি। তিনি অনেকক্ষণ তার পরিচয় রফিক বলে মানলেন না, বরং বললেন রফিক বলে কাউকে তিনি মনে করতে পারেন না। শিশুর মতো সরল মুখাবয়বে, সরল স্বীকারোক্তি করে। মামা তাকে চিনতে পারলেন। রফিক বলেই বার কয়েক সম্বোধন করলেন। অনেক পরে তিনি নিজেকে রফিক বলে পরিচয় দিতে যে দ্বিধা বা সংশয়ে ছিলেন, তা কাটাতে পারলেন। হোটেলের বাইরে তাকে হাতমুখ ধোয়াতে নিয়ে যাওয়া হলো। ফিরে এলে একটি বেে বসিয়ে দেওয়া হলো। মামা তার সাথে পুরোনো দিনের কথাবার্তা বললেন কিছুক্ষণ। খুব যে মনে করতে পারলেন এবং কথায় অংশ নিলেন মনে হলো না। তার ওষুধপথ্য ভরা একটি মিষ্টির জীর্ণ বাক্স দেখালেন। এত এত ওষুধ তাকে খেতে হয় এখন। মামা বললেন, তার পরিবারের সদস্যদের সাথে আজ দেখা হয়েছে। তারাই ঠিকানা দিয়েছেন। ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছেন। গাঁয়ের লোকেরা পথ চিনতে সাহায্য করেছেন। রফিক সাহেব এ কথার জবাবে সীমিতভাবে বললেন, ‘আমার কোনো বাড়ি নেই। আমার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। সবাইকে মেরে ফেলা হ-য়েছে। আমি পালিয়ে চলে আসছি এখানে।’

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। তার দুরবস্থা দেখে মেম মামির মমতা হলো। তিনি ব্যাগ থেকে এমিরেটসের একটি ট্রাভেলিং পাউচ দিলেন। যাতে লিপবাম, মোজা, আলোনিরোধী চোখের পট্টি (আই রেস্ট), মুখ মোছার ওয়াইপ ন্যাপকিন থাকে আরকি। দু-তিনটি টি ব্যাগও দিলেন ব্যাগের অন্য চেম্বার থেকে। মামা তার হাতে এক শ ডলার দিয়ে বললেন, ‘রফিক, তুমি তোমার প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে খেয়ো।’ পুরো সময়টা তিনি শান্তই থাকলেন। তার দুপুরের খাবার এলো। ভাত, ডাল, সবজি, অর্ধেকটা টাটকিনি মাছ। তরকারির রং লালাভ; ঝাল, মসলা চড়া বোঝা গেল। তিনি হাত প্লেটেই ধুয়ে কাঁধের গামছায় ভেজা হাত মুছে ভাত বেড়ে নিয়ে মাখতে লাগলেন। টিনের সাদা কোটিং করা প্লেট, ভেতরে নকশা প্রিন্ট করা। স্টিলের গ্লাস। পানির জগ, ভাত ও তরকারির ডিশ-চামচ-সব তৈজসপত্রই টিন বা সস্তা অ্যালুমিনিয়ামের। তবে গ্রামাঞ্চল বলে খাবারে ভেজালের ভাগ কম বলেই মনে হলো। তিনি মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা বেছে তৃপ্তি করে খেতে লাগলেন। তার খাওয়া শেষে আমরা বিদায় নিলাম।

আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। উঠতে উঠতে মামা স্বভাবসুলভ অকারণ সতর্ক করলেন। দরজা সাবধানে খোল-রে, পাশের গাছে যেন ঘষা না লাগে, দরজা লক করে বসতে হবে, দরজা যেন ঠিকভাবে লাগে। ¯øাইডিং দরজা জোর দিয়ে টেনে আনতে হবে ইত্যাদি। ড্রাইভারকেও সংলগ্ন রাস্তা থেকে হঠাৎ উঠে আসা নছিমন-করিমন খেয়াল করে চালাতে বললেন। বাঁক নিতে হবে সাবধানে, বাজার এলাকা সাবধানে ছাড়াতে হবে, ওভারটেক পারতপক্ষে ‘না’ করলেন। গাড়ি খানিকক্ষণ চলার পর মামাই প্রথম কথা বললেন, ‘রফিক ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিল। ওর ইংরেজি ড্রাফট খুবই চমৎকার। জাঁদরেল প্রফেসর বা সম্পাদকেরাও কলম ছোঁয়াতে পারতেন না। ওর সাথে আমার দেখা লেবাননে। সত্তর দশকের শেষে কি আশির দশকের শুরুতে ও লেবানন যায়। জাসদ করত, আমার মতোই। জিয়াউর রহমানের তাড়া খেয়ে আমরা সবাই লেবানন চলে গেছিলাম। আমি যেমন লেবাননে যুদ্ধের সময় মেডিকেল ক্যাম্পে কাজ করি, ও-ও যুদ্ধে অংশ নেয়, লেবাননের পক্ষে। ওর অস্ত্র চালনার ট্রেনিং ছিল। আর বাকিটা লেবাননে শিখে ফেলে। পরে জেল থেকে ছাড়া পে’ ও চলে যায় পূর্ব জার্মানি। আমাকেও তো বন্দি করা হয়, জানিস। পরে রেডক্রসের মাধ্যমে একইভাবে আমি ছাড়া পাই। আমি চলে যাই সুইডেন।’

আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘ওনার অসুখটা কী?’ মামা ডাক্তার। তিনি তার পেশাগত জ্ঞান দিয়ে বুঝিয়ে বলেন, ‘সিজোফ্রেনিয়া। এ অবস্থায় কাছের দূরের সবাইকে শত্রু মনে হয়। নানা রকম সন্দেহ আসে মনে। সূর্যের আলো আপদ বলে মনে হয়। কাজে-কর্মে একদমই উদ্যম থাকে না। যা কিছু আগের জীবনে পছন্দের ব্যাপার থাকে, তা নিয়ে আগ্রহ চলে যায়। সকালে বিছানা ছাড়তে পারে না। বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। এই সব খুবই কমন এ রোগের রোগীদের জন্য।’

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র শুনে আমার মনে হয় জন মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ তিনি বারো খন্ডই হয়তো পড়েছেন। প্রথম দুই খন্ডে শয়তানকে যে প্রশংসা করা হয়েছে, ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে যেমন রাবণকে নায়কোচিতভাবে তুলে ধরেছেন মাইকেল। সাহিত্যের সৌন্দর্যে যে মন্দকে মহান করা যায়, সেই নির্যাস তিনি নিয়েছেন একদা। এর বহু পরে আমার ‘দেয়াল’ বইটি পড়ার অভিজ্ঞতার সাথে আমি মিলিয়ে নিয়েছিলাম ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর মহিমান্বিত করে তুলে ধরা ডেভিলকে।

হুমায়ূন আহমেদ তার অন্তিম সময়ে এ পরীক্ষা-নিরীক্ষাটি করেছেন। ঘাতকদের তিনি অন্যভাবে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছিলেন। একই সময়ে আমার মনে এসেছিল সাহিত্যের সৃজনী সক্ষমতায় তো কল্পসমাজবিজ্ঞান সৃষ্টি সম্ভব। যেমন আছে কল্পবিজ্ঞান। যেমন যে জার্মান থেকে প্রবাস জীবন সাঙ্গ করে রফিক সাহেব দেশে ফিরেছিলেন, কল্পসমাজবিজ্ঞানের জিয়নকাঠির পরশে বলা হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে আর কী কী ঘটতে পারে, কল্পলোকের অনুভব থেকে একে একে লেখক আমাদের বলে যাবেন। এ রকম কিছু।

গাড়ি চলতে থাকে। মামা বলেন, ‘রফিক ছিল পূর্ব জার্মানিতে। জার্মান প্রাচীর ভাঙার আগে আগেই ও অসুস্থ হয়ে দেশে চলে আসে। এর আগ পর্যন্ত ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। ওখানে ও বিয়ে করে এক জার্মান মে’কে। ওদের একটা মে’ আছে। মে’টির নাম যত দূর মনে পড়ে আনিটা। নেতাজি সুভাষ বসুর মে’র নামে নাম। পূর্ব জার্মানিতে বেতনকড়ি ভালো না, কাজের সুযোগও তেমন নেই। শুনলি না যে, কিছুই আনতে পারেনি সাথে করে। বাড়িঘরের যা দেখলি হয়তো এত বড় ভিটেটাই রফিক কেনেছে (আ লিক উচ্চারণ)। আর এগোতে পারেনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ বইটিতে এসব নিয়ে লিখছেন। বইটা পড়ছিস? পাবনার বাসায় মামুনের সংগ্রহে আছে বইটা, পড়ে নিস। কীভাবে কমিউনিজম কলাপস্ করেসে (আ লিক উচ্চারণ), জেনে নিতে পারবি। অবশ্য রফিকের কথা ভিন্ন। ও আদর্শগত দ্বন্দ্বে দুই জার্মান এক হওয়ার পর টিকতেও পারত না। বিশ্বাস আর আদর্শের প্রশ্নে ও খুব গোঁড়া।’

– মামুন মামা কষা টাইপ লোক। তার কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়া হয়ে উঠবে না, বরং পাইরেট বই খুঁজে নেব। কম দামে কিনে পড়লাম, তাই ভালো।
– কস্টা না কষা।
– কষা কষা, কঠিন লোক, হার্ড নাট।
– কষা পাঁঠার মাংস। কচি পাঁঠা। হা-হা-হা
– যা-ই বলেন আপনি, আমার পাইরেট কিনে পড়াই ভালো।
– তুই যাই বলিস, মামুন তোকে অনেক ভালোবাসে। ওকে ভালোভাবে বলিস, ও দেবে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম ওঠায় বিধান বাবু প্রসঙ্গক্রমে বললেন, তিনিও একটি বই লিখছেন, খুলনার রূপসায় রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ, ফুলতলায় দক্ষিণডিহিতে কবির শ্বশুরালয়, খুলনার এককালের এসডিও বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাড়ুলিতে স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সাগরদাঁড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস।

উনিশ শতকে পিসি রায় এ অ লে সমবায় ব্যাংকিং চালু করেছিলেন, সে কথাও তখন জানলাম। তিনি আশা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোর চে’ও ভালো হবে বইটি। কাটতি রেকর্ড ভাঙবে। অধ্যাপক বিধান চন্দ্র বললেন, বঙ্কিম চন্দ্র খুলনার মহকুমা হাকিম হিসেবে বসবাস করতেন ভৈরব নদী তীরের এখনকার জেলা প্রশাসকের বাংলোতেই। প্রশাসনিক বিন্যাসে খুলনা তখনো জেলার মর্যাদা পায়নি বলে মহকুমা। তাই বঙ্কিম আমাদের ডিসি নন, এসডিও। ভৈরব নদীর ওপার থেকে একজন কাপালিক আসতেন বঙ্কিমের সাথে দেখা করতে, বলে শোনা যায়। এখান থেকেই সম্ভবত ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসে তিনি কাপালিক চরিত্রটি নিয়েছেন।

আরও শোনালেন, খুলনার সেনহাটিতে জন্ম নেওয়া ঊনবিংশ শতকের কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কথা। বড় বিচিত্র তাঁর জীবন। তিনি সাময়িকভাবে গৃহত্যাগী ও ধর্মত্যাগীও হয়েছিলেন। শিক্ষা জীবন বিলম্বিতভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর। ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি একাধিক সাহিত্য পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। যশোহর থেকে ‘দ্বৈভাষিকী’ নামে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর কবিতা, ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে’ অনেকটা প্রবাদপ্রবচনের মতো হয়ে আছে। সবকিছু লিখবেন তাঁর প্রকাশিতব্য বইয়ে।

আমার মনে পড়ল পঞ্চম শ্রেণিতে এ কবিতাটি আমার সম্পূর্ণটুকু মুখস্থ ছিল। আজ বুঝলাম উনিশ শতকের একজন কবি সে-ই সময়ে কতটা আধুনিক ভাষায় কবিতা লিখেছেন, যা তাঁর মৃত্যুর প্রায় শতবর্ষ পরেও একদমই খটমট ঠেকে না। এই অন্যমনস্কতা কাটল যখন কানে এল মেম মামি বারবার কী যেন বলছেন সে কথা।

বিদেশি মেম মামি প্রক্ষালনে যেতে চাইলেন। কাছাকাছি কোনো পেট্রলপাম্প ও সেই সংলগ্ন টয়লেট না থাকায় একটি বিড়ম্বনা হলো।

মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এসব দেশে এ রকম ভালো ব্যবস্থা নেই, ও বুঝতে চায় না।’ একটি গৃহস্থ বাড়িতে মেম মামিকে নেওয়া হলো, মোটা চট টানিয়ে শৌচাগারের দরজার বিকল্প করা। কিছু অংশে শুকনো কলাপাতা ডগা সমেত ঘেরায় ব্যবহার করা হয়েছে। মেম মামি এতেই সুন্দরভাবে টয়লেট শেষ করে হাসিমুখে গাড়িতে ফিরলেন। শুনেছি, পশ্চিমা দেশে স্কুলেই এমন ট্রেনিং দেয় যেন তুমি বনবাদাড়েও শয্যা পেতে শান্তির নিদ্রা দিতে পারো। সেই মূলমন্ত্রে প্রশিক্ষিত হওয়ার ব্যাপারটির হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। আমরা একই বিরতিতে গাড়ির মধ্যেই হোটেল থেকে আনা পার্সেল খুলে খেলাম। এ নিয়েও মামা অনেক আদিখ্যেতা করলেন। হাত ভালো করে ধুয়ে বাক্স ধর, চামচ দিয়ে খা, ডিসপোজেবল গ্লাসগুলো ফ্ল্যাস্কের গরম পানিতে খলিয়ে নে, মুখ বন্ধ করে খেতে হয়, জানালা দিয়ে কিছু ফেলিস না, গারবেজ ব্যাগে রেখে দে, শেষ হওয়া খাবারের বাক্সগুলো ভালো করে বেঁধে রাখ, যেন খুলে যেয়ে নোংরা না হয়…জাতীয় কথাবার্তা। এর মধ্যে আছরের আজান হলো, গাড়ির রেডিওতে। মামা আড়াই দশকের মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে প্রবাস জীবনযাপন করেন। একটানা সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখেন না কয়েক মাস। এই তার অভ্যস্ততা। তিনি বললেন, ‘এশার আজান হলো নাকি?’ এতে ড্রাইভার সাহেব খুবই বিরূপ হলেন। এমন না যে তিনি গাড়ি থামিয়ে নামাজের বিরতি চাইলেন, পথে নামাজ পাঠ করলেন, এতটা প্র্যাকটিসিং তিনি ছিলেন না। কিন্তু মূল্যবোধ তার শাণিত। সারা পথ এমনকি পৌঁছানোর পরও আর কোনো কথা বলেননি তিনি।

এরপর অনেক বছর কেটে গেল। একদিন বিধান চন্দ্র রায়ের সাথে দেখা হওয়ায় কথায় কথায় ২০০৫ সালের এক শীত-শীত দিনের আমাদের সেই ভ্রমণের কথা উঠল। তাঁর বইটির কথা তেমন কিছু উচ্ছ¡াস নিয়ে বললেন না। বুঝলাম যেমন ভেবেছিলাম, তেমন সাড়া ফেলতে পারেননি। তিনিই বললেন, যশোহরে এমএ আউয়াল নামে একজন শিল্পীজনোচিত ডিসি এসেছেন। তিনি সাগরদাঁড়িতে কবি মধুসূদন দত্তের পৈতৃক বাড়িটি আরও সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করেছেন। গাইডদের প্রশিক্ষণ দেওয়ানো হয়েছে। প্রদর্শিত সবকিছু আকর্ষণীয় করতে তথ্য সংযোজন করেছেন, পিভিসি ডিসপ্লে বোর্ডে, সবখানে নামফলক লাগিয়েছেন পরিচিতির জন্য, স্যুভেনির শপ চালু করেছেন। স্যুভেনিরের দোকানে কবির বই, জীবনী, পুস্তিকা, পোস্টার, কবির ছবি উৎকীর্ণ স্কেল পেনসিল পাউচ, ক্লিপ বোর্ড ইত্যাদি বিক্রি হয়। পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষ জোরারোপ করেছেন। প্রক্ষালনের সুব্যবস্থা করেছেন আলাদা অংশে, নতুনভাবে নির্মাণ করে। এখন গেলে আর কোনো দর্শনার্থীকে টয়লেট সুবিধা নিয়ে ভাবতে হয় না। বাড়ির বাইরে এলামাটির রং বদলে ওয়েদার কোটে ক্রিম কালার, বর্ডারে শাদা পেইন্ট করিয়েছেন। ভেতরে চুনকামের বদলে প্লাস্টিক পেইন্ট করিয়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করেছেন। কলকাতা, মাদ্রাজ, ইংল্যান্ড, ভার্সাই যেখানে যেখানে কবির স্মৃতি আছে, তার একটি করে হলেও ছবি সংযোজন করেছেন। পারিবারিক ছবি, পোর্ট্রটে ও আরও অনেক ছবি খুঁজে পেতে প্রিন্ট করে প্রদর্শনীর জন্য দিয়েছেন। ফান্ড পেলে একটি রেকর্ডকৃত বর্ণনা ও কবির কবিতার আবৃত্তি বাজিয়ে দর্শনার্থীদের আরও আলোকিত-সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। শুনে ভালো লাগল। যে কবি বাংলা ভাষায়ও অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্যচর্চা সম্ভব, তা অনেকে নাকচ করা সত্তে¡ও একরকম চ্যালেঞ্জ নিয়ে সর্বাত্মক সফলভাবে করে দেখিয়েছেন। যে নাট্যকার প্রথম প্রহসন নাটক রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে শৈলী ও বিষয় ভাবনার আড়ষ্টতার সমূলে মূলোৎপাটন করেছেন, তার স্মৃতি রক্ষা তো পরম আরাধ্য। জেলা শাসক আউয়াল মহোদয় কবির প্রপৌত্রীর সন্তান ভারতীয় টেনিস জগতের মহাতারকা লিয়েন্ডার পেজকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। লিয়েন্ডার পেজ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সুবিধাজনক সময়ে সাগরদাঁড়ি ভিজিটের আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিধান বাবুর কাছে চমকপ্রদ, মন খুশি হওয়ার মতো এত সব খবর পেয়ে খুবই ভালো বোধ করলাম। আমার উৎসাহ ও সদর্থক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলে গেলেন, মাইকেলের দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটার ঘরেও তিন সন্তান ছিলেন। সব থেকে ছোট ছিলেন অ্যালবার্ট নেপোলিয়ন দত্ত। তিনি স্বল্পায়ু ছিলেন। তাঁর ছিল দুই ছেলে, তিন মে’। এক ছেলে মাইকেল ডট। তাঁর মে’ জেনিফার ডট, বিবাহসূত্রে হয়েছিলেন জেনিফার পেজ। ভারতীয় জাতীয় মহিলা বাস্কেটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। অলিম্পিকেও খেলেছেন। তাঁরই সন্তান লিয়েন্ডার পেজ।

এই পরম্পরা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে যায় রফিক মামার কথা। তাঁর জার্মানিতে ফেলে আসা সংসারে স্ত্রী ও বিশেষত কন্যা আনিটার কথা। তাকে ডাকলে বা নিজে খুঁজে আনিটা কি আসবে তার পিতাকে দেখে যেতে বা পিতৃভিটায়?

জগতে এমন কিছু সংযোগ থাকে, যাতে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নেই অমোঘ আকর্ষণক্ষমতা নিহিত থাকে। মা-বাবা নানা কারণেই সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন এমনকি নিখোঁজ পর্যন্ত হতে পারেন। তবু বাবা কিংবা মা অথবা ক্ষেত্র বিশেষে নিকট আত্মীয় বলে শুধু জানার কারণে, যত দূরবর্তী থাকুন এমনকি নাগালের একদম বাইরে, তবু তাঁর প্রতি গভীর মমতা পোষণ করেন সন্তান কিংবা সন্তানসম ব্যক্তি। তাঁরা অবস্থার চাপে সন্তানের প্রতি কর্তব্যটুকু পালন করতে পারেননি যদি তেমনও হয়। হতে পারে সন্তানের বুঝতে শেখার পর কোনো দিন সাক্ষাৎও হয়নি। তবু কী অসীম টান, কী শাশ্বত আকর্ষণ, একবারের জন্য দেখা হওয়ার কী সকরুণ আকুতি থাকে, তা হাজার শব্দে লিখেও বোঝানো যাবে না। হারানো আপনজনের সন্ধান জানামাত্রই সশরীরে ছুটে আসতে না পারলে মন ছুটে আসে তখনই। আমার বিশ্বাস, আজকের জার্মান তরুণী মিজ আনিটাও এর ব্যতিক্রম হবেন না।

লেখক : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব ও মিডিয়া কনসালট্যান্ট, মুজিববর্ষ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!